রাজিব শর্মা »
কোরবানির পশু বিক্রির বিকল্প মাধ্যম অনলাইনে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা ওয়েব পোর্টাল। স্থায়ী ও অস্থায়ী পশুর হাটের পাশাপাশি এবারও অনলাইনেও রয়েছে পশুর হাট। বিভিন্ন খামারিরা এসব হাটে গরু কেনাবেচা করেন। তবে এবার অনলাইনে পশুর হাটের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে কোরবানের পশু কেনাবেচা।
ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পশুর হাটে গিয়ে ভিড় ও নানা জটিলতাসহ নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় ক্রেতাদের। তার মধ্যে অনেকেই থাকেন কর্মব্যস্ত। প্রযুক্তির বিকাশে ও অনলাইনে সেবার মান বাড়াতে সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণ উদ্যোক্তারাও অনলাইনমুখী হয়েছেন। যার ফলে হাটগুলোর চেয়ে অনেকটা অনলাইনে ঝুঁকছেন ক্রেতারা। তবে সুবিধার পাশাপাশি অনলাইনে পশু কেনার অন্যতম অসুবিধা হলো প্রতারণা। অনেক খামারি বা অসাধু ব্যবসায়ীরা ভিন্ন পশুর ছবি ও ভিডিও দিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এছাড়া পশুর সঠিক আকার, ওজন বুঝতে না পারাও অনলাইনে পশু কেনার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করছে। তবে এবার প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে অনলাইনে কেনাবেচা হয়েছে কোরবানের পশু।
সরকারের ডিজিটাল হাটের জন্য পশুহাট ওয়েবসাইট চালু করেছে আইসিটি বিভাগ। সেখানে দেশের ৬৪টি জেলায় অনলাইনে পশু বিক্রি করা হয়। করোনা মহামারিতে এ ওয়েব সাইটের মাধ্যমে সারাদেশে পশু কেনার সুবিধা চালু করা হয়। যার ফলে দিন দিন বেশি ক্রেতার সাড়া পড়ছে অনলাইনে।
ওয়েবসাইটটি ভিজিট করে দেখা যায়, ৬৪ জেলার জন্য আলাদা ক্যাটাগরিতে পশু বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন খামারিদেরও আলাদা ক্যাটাগরি রয়েছে। ওয়েবসাইটে ক্রেতার সুবিধার জন্য ছবি-ভিডিও’র পাশাপাশি পশুর বর্ণনা ও মূল্য উল্লেখ রয়েছে। এসব বিজ্ঞাপন সাঁটানো পশুর স্বতন্ত্র একটি কোড উল্লেখ করা রয়েছে। ক্রেতারা পশুর বিজ্ঞাপন থেকে বিক্রেতার তথ্য নিয়ে যোগাযোগ করতে পারছেন।
চট্টগ্রামের ৩৭ টিসহ ৩৫৯ প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে পশু বিক্রি
এক জরিপে দেখা গেছে এবার চট্টগ্রাম মহানগরে ৩৭ টি খামারি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে গরু কেনাবেচা করছে। যার মধ্যে অন্যতম এশিয়ান এগ্রো ফার্ম, জয়তুন এগ্রো ফার্ম, নাহার ক্যাটল ফার্ম, সারা এগ্রো ফার্ম, শাহ আমানত এগ্রো, এন এম এগ্রো, রয়েল রেঞ্জ, তাওয়াক্কুল এগ্রো ফার্ম, কেজিএন এগ্রো, মেসার্স বিসমিল্লাহ এগ্রো, খান এগ্রো, আরবিএস এগ্রো, এসএনএম এগ্রো, এগ্রো আউয়ার, এগ্রো ২১, সিকদার এগ্রো, গ্রীন হারভেস্ট এগ্রো, আবেদিন এগ্রো ডেইরি ফার্ম, সাঙ্গু ফার্ম এগ্রোভেট, ডক্টরস ক্যাটল ফার্ম, মাসাল্লাহ এগ্রো, এস কে এগ্রো ডেইরি ফার্ম, মুনিরিয়া ক্যাটল ফার্ম লিমিটেড, সালাম ফাতেমা এগ্রো, হালাল এগ্রো ফার্ম, চাটগাইয়া এগ্রো, গ্রীণ এগ্রো ফার্ম বিডি, ইনফিনিটি মর্ডাণ এগ্রো লিমিটেড, সার্ম এগ্রো, রস্তম এগ্রোসহ এ ৩৭ টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি অনলাইনে পশু বিক্রি করছে। এছাড়া অনান্য অনলাইনে সাইটে নিজেদের নামে আরও অর্ধ শতাধিক অনলাইন ব্যবসায়ীরা পশু বিক্রি করছে। অন্যদিকে এবার চট্টগ্রাম জেলা ও জেলার বাইরে থেকেও সারাদেশে ৭২টি অনলাইনভিত্তিক পোর্টালসহ ৩৫৯টি তালিকাভুক্ত খামারি অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করছে।
শতভাগ পশু বিক্রিতে সফল খামারিরা
এদিকে গরুর হাটগুলোতে পর্যাপ্ত গরুর পাশাপাশি ক্রেতা থাকলেও দাম নাগালের মধ্যে না থাকাতেই ক্রেতারা গরু কিনতে পারছেন না। কিন্তু ভিন্ন চিত্র দেখা যায় নগরীতে গড়ে উঠা খামারিদের মধ্যে। যাদের কয়েকটি খামারে কিছু গরু অবশিষ্ট থাকলেও প্রায় সব পশু কোরবানের আগেই বিক্রি হয়ে গেল বলে জানিয়েছেন এ ব্যবসায়ে জড়িত খামারিরা। বর্তমানে ক্রেতাদের মাঝে পশু সরবরাহে ব্যস্ত খামারিরা।
বায়েজিদ এর এশিয়ান কমপ্লেক্স টেক্সটাইল গেইট এলাকায় বিক্রয় প্রর্দশনী কেন্দ্র খুলছে এশিয়ান গ্রুপের মালিকানাধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এশিয়ান এগ্রো। এবার কোরবানি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ২৫০ টি গরু প্রস্তত করেছিলেন, যার মধ্যে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ২৩৭ টি গরু বিক্রি করেছেন প্রতিষ্ঠানটি। তবে আশানুরুপ দাম পাননি বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ওয়াসিফ আহমেদ সালাম।
তিনি বলেন, আমরা বিগত ছয়বছর ধরে খামারের সঙ্গে জড়িত। প্রতিবছরই অনলাইন ও নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে পশু বিক্রি করছি। কিন্তু অনান্য বছরের তুলনায় এবার ৯৫ শতাংশ গরু বিক্রি হলেও আশানুরুপ দাম পাইনি আমরা। যার মূল কারণ খামারে পশুপালনে খরচ বেড়েছে। দেখা যাবে আগামীতে অনেক খামারিরা পশু পালন থেকে সরে আসবে। তবে এবারও আমরা ক্রেতাদের সার্মথ্যের বিষয়ে মাথায় রেখে গরু বিক্রি করেছি এবং কোরবানের দিন সকাল পর্যন্ত সঠিক সময়ে আমরা ক্রেতাদের কাছে গরু পৌঁছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।
কালুরঘাট শিল্প নগরীর বাদামতল মোড় এলাকায় বিক্রয় প্রদশর্নী কেন্দ্র সারা এগ্রো ফার্ম। প্রতিষ্ঠানটি এবার কোরবানের জন্য ২৭০ টি গরু প্রস্তুত করেছে। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ১৭টি গরু ছাড়া বাকিসব বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির ম্যানের আবদুল বাতেন।
তিনি বলেন, অনান্যবারের তুলনায় এবার ভালো দাম পেয়েছি। ২৭০ টি গরু বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছিলাম যার মধ্যে আর ১৭টি বাকি আছে। আশা করি আজকে ছুটির দিনেই বিক্রি হয়ে যাবে।
পশ্চিম নাসিরাবাদ ১২ নম্বর কসমোপলিটন এলাকায় প্রদর্শনী কেন্দ্র খুলেন গ্রীন হারভেস্ট এগ্রো। প্রতিষ্ঠানটি এবার ১২৫টি গরু খামারে পালন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মো. মারুফ বলেন, কোরবানকে ঘিরে গ্রিন হার্ভেস্ট এগ্রো এবার ১২৫ টি গরু প্রস্তুত করেন। যার মধ্যে ৮৫ টি গরু বিক্রি হয়েছে। আজ (গতকাল) ও আগামীকালের মধ্যে আমরা বাকিসব গরু বিক্রি করতে সফল হবো। আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যকর গরু পালন করেছি। যার ফলে ক্রেতারা অনেকটা আমাদের উপর আস্থা রাখেন।
শিকলবাহা মইজ্জারটেক এলাকার পশু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান শাহ আমানত এগ্রোর ম্যানেজার বলেন, আমাদের খামারে ১০০ টি গরু প্রস্তুত ছিল। তা বিক্রি হয়ে গেছে। এখন ক্রেতাদের কাছে গরু সরবরাহের প্রস্তুতি চলছে। অনান্য বছরের তুলনায় এবার আগেই বিক্রি হয়েছে।
সচেতন ক্রেতাদের আস্থার জায়গা অনলাইন
অন্যদিকে চারদিকে প্রতারণার শিকার হওয়ার ভিড়ে এবার পশু কেনার জন্য অনলাইনকে আস্থার জায়গা বলে মনে করছেন কোন কোন ক্রেতা।
এশিয়ান এগ্রো থেকে গরু কেনেন মো. আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত তিন বছর ধরে হাটে যায় না। হাটে দালাল, প্রতারক চক্র, ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়। তার মধ্যে কোনটি সুস্থ বা অসুস্থ গরু বুঝা যায় না। যার ফলে অনলাইনকে নিরাপদ মনে করি। আর বর্তমান যেসব তরুণরা উদ্যোক্তা হচ্ছে, তাদের উৎসাহিত করাও আমাদের প্রয়োজন। তাই আমি বরাবরই অনলাইন থেকে গরু কিনি।
তিনি আরও বলেন, গতবছর সারা এগ্রো থেকে গরু কিনেছিলাম, এবার কিনলাম এশিয়ান এগ্রো থেকে। দাম তেমন বাড়তি রাখেননি প্রতিষ্ঠানটি। কোরবানের দিন গরু পাঠিয়ে দেবে। কোন ঝামেলা নেই।
এদিকে নাসিরাবাদ এলাকার অনলাইনভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে গরু কেনেন খুলশীর শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, পরিবারে পুরুষ না থাকায়, হাটে যাওয়া সম্ভব হয় না। এবার অনলাইনে নিজে দেখেই, পরে খামারে যোগাযোগ করে গরু কিনেছি। আমার কাছে হাটের বিড়ম্বনার চেয়ে অনলাইনেই ভালো লাগে। আর বিশ্বস্ত খামার হলে ঝুঁকি নেই। একটু বাড়তি হলেও এসব ক্ষেত্রে আমার কাছে অনলাইনই ভালো লাগে।
পাঁচলাইশের আবদুল হালিম সওদাগর গরু কেনেন অনলাইন থেকে। তিনি বলেন, সরকার অনলাইনে গরু কেনার জন্য বেশ সহজ করে দিয়েছে। যোগাযোগ মাধ্যম সহজ হওয়াতেই আগের মতো হাটে যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। সহজেই সব তথ্য নিয়ে গরুর মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। আর খামারিরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ভালো পরিবেশে গরু পালন করেন। যার কারণে এবারও অনলাইনে সব দেখে পরে খামারে যোগাযোগ করেই পশু কিনেছি।
জেলা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে এবার কোরবানিতে চট্টগ্রাম জেলায় সম্ভাব্য কোরবানির পশুর চাহিদা ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬৫টি। জেলার ১৫টি উপজেলা এবং শহরে কৃষকের খামারে মজুদ থাকা কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর মধ্যে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪৭৫টি গরু, ৭১ হাজার ৩৬৫টি মহিষ, ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৩টি ছাগল, ভেড়া ৫৮ হাজার ৬৯২টি ও অন্যান্য পশু রয়েছে ৮৮টি। সে হিসেবে মোট পশু রয়েছে ৮ লাখ ৫২ হাজারের একটু বেশি। চাহিদা অনুযায়ী তেমন প্রভাব পড়বে না এবং হাটের আগেই এবার খামারিরা শতভাগ গরু বিক্রিতে সফল বলে জানান জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আমাদের খামারগুলোতে পশুর জন্য কোন ভেজাল খাবার, ক্ষতিকর মেডিসিন ব্যবহার করা হয়নি। বলা যায় বেশ পরিচর্যার মধ্যে দিয়ে গরু পালন করা হয়। অনেক আগে থেকেই সচেতন ব্যক্তিরা খামারের গরু অনলাইনে দেখে পরে খামারে যোগাযোগ করে কিনে নেন।
তিনি আরও বলেন, খামারে গরু বিক্রির পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমগুলো। যার পেছনে সক্রিয় শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম কাজ করেছে। যার ফলে হাটের আগেই এবছর খামারে গরু শতভাগ বিক্রি হয়েছে। আগামিতে তরুণরা আরও এগিয়ে আসবে বলে মনে করেন জেলা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা।