হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সমস্ত প্রশংসার মালিক, যিনি নিজ বান্দার প্রতি সদয়, অনুগত-উদ্ধত সবাইকে তিনি রিয্ক দেন। কৃতজ্ঞতা সেই প্রভুর, যাঁর হুকুম ছাড়া আমাদের নিঃশ্বাস চলে না, তিনিই অনুমোদন করেন আমাদের হৃদস্পন্দন ক্রিয়ার। তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করি প্রতিক্ষণে যিনি তাঁর ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্তারোপ করেছেন।
আল্লাহ্র একত্ব ঘোষি, তিনিই একমাত্র উপাস্য, আর কেউ বা কিছু তাঁর সমকক্ষ বা শরীক নেই। তাঁর রাজত্বে, প্রভুত্বে কারো কোন অংশীদারিত্ব নাই। আমাদের কা-ারী, পথ নির্দেশক, পথপ্রদর্শক হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহরই বান্দা, তাঁর রাসূল। তিনি অতুলনীয় বান্দা, তিনি শ্রেষ্ঠতম রাসূল। এ বিশ্বাসই মুক্তির অপরিহার্য শর্ত।
মানুষ বর্তমানের বাসিন্দা। কারণ, অতীত হাতছাড়া, আর ভবিষ্যৎ হবে অনাগত, অনিশ্চিত। তবে রহস্যের ব্যাপার হলো, ‘বর্তমান’র এ অস্তিত্ব অতি সংক্ষিপ্ত, দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু, লয়প্রাপ্ত। বলতে বলতেই তা অতীতের গর্ভে হারিয়ে যায়। জমা থাকে অতীতের স্মৃতিকোটায়। জীবনটা একটি দম’র সাথে সাথে থেমে যেতে পারে। অনুমানভিত্তিক একটি গড় আয়ু প্রত্যেকে নিজের জন্য ধরে নেয়, তবে স্বীকার করে যে, দম’র ঘড়ি ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে নয়। পদবী কারো নিয়ন্ত্রক হলেও তাঁর নিঃশ্বাস কিন্তু নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। বর্ণিত আলোচনা থেকে মেনে নেওয়া যায় যে, আমাদের ভবিষ্যৎ নিঃশ্বাসে বাধা এবং এ নিঃশ্বাস বা ‘দম’ বা হৃদস্পন্দন বন্ধ হতে পারে যেহেতু যে কোন মুহূর্তে, তাই পরবর্তী দম নেয়ার আগেও আমরা যে কেউ হতে পারি পরকাল যাত্রী। দম ফুরিয়ে গেলেই আমাদের জীবন- মেয়াদ স্মৃতি ফলকে স্থির হয়ে যায়। অতীতই প্রত্যেকের জীবনে ইতিহাস। অতীত হারিয়ে যায়, আর দম বন্ধ হয়ে গেলে অতীতের প্রতিটি মুহূর্তের ভাল-মন্দ রেকর্ড হয়ে চূড়ান্ত স্থান পায় আমল-নামায়। বিশ্বাসী নর-নারী এটিকে উপেক্ষা করতে বা এড়িয়ে যেতে পারে না। এটা নিয়েই প্রত্যেককে বিচারের দিন আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ্র সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান পরাক্রমশালী বিচারদিনের মালিক আল্লাহ্র ঘোষণা, ‘আমি প্রতিটি ইনসানের ভাগ্যকে তার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছি। আর কিয়ামতের দিন তার জন্য একটি লিপিবদ্ধ নথি বের করে দেব, যা সে উন্মুক্ত অবস্থায় পাবে। (তাকে বলা হবে) তুমি নিজেই পড়ে দেখো তোমার কর্মলিপি, আজকের দিনে তোমার হিসাবের জন্য তুমিই যথেষ্ট। (সুরা বনী ঈসরাঈল : ১৩-১৪)
অতীতকে অগ্রাহ্য করা যায় না, তা একদিন সামনে আসবেই, যেদিন বিচারক হবেন আল্লাহ্ জাল্লা জালালুহ্, আর নওয়াব-নফর, বাদশাহ্-ফকীর নির্বিশেষে আমরা হবো অভিযুক্ত, আসামি। আমলনামায় লিপিবদ্ধ থাকা অতীতেরই কীর্তিকলাপ। যতক্ষণ জীবনের ঘড়ি থাকবে চলমান, ততক্ষণ এক একটি বর্তমান মুহূর্ত অতীতে হারাবে, ক্ষয়ে যাবে ভবিষ্যৎ। তাই, অনাগত ভবিষ্যৎ দ্রুত পরিশুদ্ধ করে নিতে কাজ করতে হবে এখনই, আর মনে রাখতে হবে আমাকে আমার মালিকের কাছে নিজ কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। মানুষ অন্যকে মূল্যায়ন করে থাকে তাঁর আকীদা-আমল, দর্শন-কর্মের ভিত্তিতে। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে পূর্বযুগের বান্দাদের অনেক ঘটনাবলির ইঙ্গিতধর্মী বর্ণনা দিয়েছেন, কোথাও কোথাও ঘটনার বিস্তৃতিও রেখেছেন। গল্পের মত একস্থানে দীর্ঘকলেবর বর্ণনা না হলেও শিক্ষা, উপদেশমূলক বর্ণনা পবিত্র কুরআনের বহুস্থানে রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যেমন, আদম (আ.)সহ একাধিক পয়গম্বরের কথা মুসা (আ.), ঈসা (আ.), ইবরাহীম (আ.)-এঁদের বহু ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি বিপরীতে ফিরআউন, হামান, কারূন-এর মত কুখ্যাত রাজশক্তিবর্গেরও কথা স্থান পেয়েছে। সুরা হূদ-র ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে এমন ব্যক্তির জন্য, যে আখেরাতের আযাবকে ভয় করে। দিনটি এমন যে, পৃথিবীর সকল মানুষই যেদিন একস্থানে সমবেত হবে, আর তা তো হাজির হবারই দিন। আর আমি তা প্রতিশ্রুত মেয়াদের জন্যই বিলম্বিত করছি। পবিত্র কুরআনে লিপিবদ্ধ সবগুলো সুরাই অকাট্য ও সন্দেহাতীত হলেও একেকটি সুরার মধ্যে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সুরা হূদও এমন কিছু বৈশিষ্ট্যম-িত, যা একে অন্য সুরা হতে আলাদারূপে চিহ্নিত করেছে। তিরমিযী শরীফে হাদীসে রয়েছে, একদিন রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র কয়েক গাছি দাঁড়ি মুবারক পাকা দেখতে পেয়ে বিচলিত হয়ে হযরত আবু বকর (রাদ্বি.) আরয করলেন, আপনি বার্ধক্য উপনীত হয়ে গেলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্? তখন আল্লাহ্র রাসূল ইরশাদ করলেন ‘হ্যাঁ, কুরআন মাজীদ’র সুরা হুদ আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে’। কোন কোন বর্ণনায় সুরা হূদ’র সাথে ওয়াকিয়া, সুরসালাত, নাবা ও সুরা তাকভীর’র নামও উল্লেখ হয়েছে। এর কারণ, এ সুরা হূদÑএ বর্ণিত বিষয়গুলো ভীতিপ্রদ, অতিগুরুত্ববহ এবং পূর্ববর্তী শক্তিশালী জাতি, গোষ্ঠীর ওপর আযাবের কারণে ধ্বংস নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনাবলী রয়েছে। এগুলোর গুরুত্ব ও উম্মতের সুরক্ষার চিন্তাÑউদ্বেগ তাঁকে প্রভাবিত করার চেয়েও যে কারণে তিনি বেশি চিন্তিত ছিলেন, তা হলো, তাতে বর্ণিত ছোট্ট একটি আয়াত, ‘ফাস্তাকিম কামা উমিরতা’। (অর্থাৎ আপনাকে যেমনটি নির্দেশ করা হয়েছে, সেভাবে আপনি স্থিরপদ থাকবেন।) এ আয়াতটির কারণেই তিনি বার্ধক্যপীড়িত হন। (কুরতুবী)।
সূরা হূদ-এ সাতজন বিশিষ্ট নবী রাসূলগণের সাথে নিজ নিজ সম্প্রদায় যেসব গর্হিত আচরণ করেছিল সেগুলোর বর্ণনা এবং তাদের ধ্বংস হবার ভয়াবহ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। যাতে নিহিত রয়েছে বহু উপদেশ, প্রজ্ঞা, নির্দেশনা, বিধিবিধান ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে সম্বোধন করে বলেন, ‘ওটা পূর্ববর্তী জনপদগুলোর সংবাদ কাহিনী, যা আমি আপনার নিকট বর্ণনা করছি। তন্মধ্যে কোন কোনটি বহাল, কোন কোনটির শেকড় কর্তিত। আমি তাদের প্রতি জুলুম করি নাই; বরং তারাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে। আপনার পালনকর্তার হুকুম যখন এসে পড়ল, তখন আল্লাহ্কে ছেড়ে তারা যেসব ভ্রান্ত উপাস্যদের ডাকত, তারা তাদের কোন উপকারে আসল না। তারা তাদের বিপর্যয় ছাড়া কিছুই বাড়াতে পারল না। আর এরূপই আপনার প্রভুর ধরা, যখন কোন জালেম অধ্যুষিত জনপদকে গ্রাস করে (তখন এরূপই পাকড়াও করে) নিশ্চয়, তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত কষ্টদায়ক, কঠোর’। এরপরই পূর্বোক্ত আয়াত মুবারক রয়েছে, যা আজকের আলোচ্য হিসাবে খুৎবায় সংকলিত হয়। যাতে বলা হয়েছে, আগে ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদ এবং এতে বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলোর শোচনীয় পরিণতিরই ইতিবৃত্ত রয়েছে, যা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করতে হবে।
পবিত্র কুরআন আল্লাহ্র দেয়া বিধি-বিধানের পবিত্র বাণী। প্রারম্ভেই বলা হয়েছে, এটা সন্দেহমুক্ত কিতাব, খোদাভীরুদের জন্য হেদায়েত তথা পথ নির্দেশনা। নয়তো আল্লাহ্ শিশুদের ঘুম পাড়ানো নিছক গাল-গল্প শোনানোর লক্ষ্যে, নাউ-যু বিল্লাহ্! অহী অবতরণ করেননি। তবে এ গ্রন্থে অবিশ্বাসীরা যেভাবেই দেখুক, নির্মম বাস্তবতার নিরেট সত্য ঘটনার কথাই বর্ণিত। এ বর্ণনায়, যে ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদ ও অধিবাসীদের কাহিনী বলা হয়েছে, তার কিছু কিছু সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন, বিলুপ্ত। আবার কিছু কিছুর আংশিক ধ্বংসাবশেষ, নিদর্শনাদির কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও বিদ্যমান। সুরার শততম আয়াতে ‘ক্বাÑইমুন ওয়া হাসীদ’Ñবাক্যে এটাই বলা হয়েছে। এগুলো ইতিহাস বা রাজন্যবর্গের কাহিনী চর্চার উদ্দেশ্যে নয়; বরং অতীতের ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে। শাসক কিংবা রাজাÑবাদশাহ্ মানুষের প্রভু নয়, আল্লাহ্ই সকলের প্রভু, রাজাÑপ্রজা নির্বিশেষে সবাই আমরা আল্লাহ্রই বান্দা, তাঁরই সৃষ্টি, তিনিই সকলের রিজিক দেন। তাই প্রকৃত প্রভুও তিনিই। যুগে যুগে মানুষ গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিল আল্লাহ্ ও রাসূলের নির্দেশ উপেক্ষা করে। ইহকালের সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও সুবিধাভোগীদের তোষামোদ রাজন্যদের অহঙ্কারী ও স্বেচ্ছাচারী করে তোলে, তাঁরা প্রভু ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আল্লাহ্র ক্রোধ ‘গযব’ রূপে নেমে আসে। পূর্বেকার ধ্বংসপ্রাপ্তদের ঘটনা হতে আমাদের শিক্ষা নেয়া অপরিহার্য।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।