নিজস্ব প্রতিবেদক »
‘চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে । আগে কি-গ্যান্ট্রি ক্রেনের স্বল্পতা ছিলো। এখন ১৮টি কি-গ্যান্ট্রি ক্রেন আছে। একটি ইক্যুইপমেন্ট অচল হলে এখন আর অপেক্ষা করতে হয় না। সেটির পরিবর্তে অন্যটি এনে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে কাজ করা যায়। বিশ্বের উন্নত বন্দরে সবকিছু অটোমেশনে পরিচালিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরেও সবকিছু যেন অটোমেশনে হয়, সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। তাই বলা যায়, আগামীতে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালিত হবে অটোমেশন প্রযুক্তিতে।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বন্দর দিবস উপলক্ষে শহীদ মো. ফজলুর রহমান মুন্সী অডিটোরিয়ামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান এ মন্তব্য করেন।
অটোমেশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরে রূপান্তর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগকে অটোমেশন করতে ৫০টি সফটওয়্যার মডিউল তৈরি হচ্ছে। যার মাধ্যমে বন্দরকে পেপারলেস প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব হবে। বিপজ্জনক, তেজস্ক্রিয়, রাসায়নিক পণ্য নিরাপদে আমদানি রপ্তানির সুবিধার্থে স্টেট-অব-আর্ট কেমিক্যাল শেড গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পোর্ট লিমিট (বন্দর এলাকা) ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে ৬২ নটিক্যাল মাইলে উন্নীত করা হয়েছে। রপ্তানি কনটেইনার স্ক্যান করতে ২টি আধুনিক স্ক্যানার সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যা ২০২৩ সালের জুন নাগাদ স্থাপন সম্ভব হবে। হামিদচরে লাইটারেজ জেটি তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বন্দরের পাইলটদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে ২১০ মিটার লম্বা ও সাড়ে ১০ মিটার জাহাজ ভেড়ানো যাবে। হজযাত্রী ও পর্যটকবাহী জাহাজ বার্থিংয়ের সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর মোহনার তীরে ২০০ মিটারের যাত্রীবাহী টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে সমীক্ষা চলছে।’
বন্দরের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে এক দশকে ৫ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মাণ করায় কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৫৫ হাজার টিইইউসে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে শিপ টু শোর কি গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের ৩১০টি ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৮টি কি গ্যান্ট্রি ক্রেন রয়েছে বন্দরে। ইজি অব ডুয়িং বিজনেসের সব সূচক আমরা দ্রুত অর্জন করেছি। ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর সক্ষম। ইতিমধ্যে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্টের কয়েকটি ট্রায়াল রান সফল হয়েছে। কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং সম্পন্ন করেছি আমরা। বন্দরের বার্থিং ডিজিটালি (প্রযুক্তিগতভাবে) হয়ে থাকে। এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে অবস্থান করছে।’
পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পিটিসিতে (পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল) ইতোমধ্যে একটি মাদারভ্যাসেল ভিড়েছে। পিটিসি অপারেশনে নিতে আমরা এখন আন্তর্জাতিক অপারেটর খুঁজছি। আন্তর্জাতিক অপারেটর নেওয়ার কারণ হলো তাদের কাজের সাথে তুলনা করে আমরা প্রতিযোগিতা করে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়াতে পারবো। এছাড়া দেশ আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। পিটিসি চালু হলে পয়েন্ট (দশমিক) ৪৫ মিলিয়ন কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বাড়বে।’
বে-টার্মিনাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বে-টার্মিনালে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ কাজ যথেষ্ট এগিয়েছে। নিষ্কণ্টক জমি নামমাত্র বা প্রতীকী মূল্যে পেতে যাচ্ছি। বে-টার্মিনালে তিনটি টার্মিনাল হবে। সেটার মাস্টারপ্ল্যানও প্রস্তুত হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ে বে-টার্মিনালের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিক মহলে এগিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জাহাজ বহির্নোঙরে আসার এক থেকে দুই দিনের মধ্যে জেটিতে ভিড়ছে, ক্ষেত্রবিশেষে অন অ্যারাইবল বার্থিং দেওয়া হচ্ছে। ৫৮৪ মিটার লম্বা জেটিসহ পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে বছরে সাড়ে ৪ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রার এ টার্মিনালে ২০০ মিটার লম্বা ১০ মিটার ড্রাফটের ২টি কনটেইনার জাহাজ এবং ২২০ মিটার লম্বা ডলফিন জেটিতে তেলবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে। টার্মিনালটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি অপারেটর দ্বারা পরিচালনার সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পিপিপি কর্তৃক ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজর হিসেবে আইএফসিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা ট্রানজেকশন স্ট্রাকচার রিপোর্ট দিলে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’
ইউএস রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এমভি সোঙ্গা চিতা ৯৫২ কনটেইনার রপ্তানি পণ্য নিয়ে ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। এটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। এতে ট্রান্সশিপমেন্ট বিলম্ব না থাকায় ১২-১৫ দিনের মধ্যে ১০-১২ হাজার ডলার খরচে রপ্তানি পণ্য ইউরোপের বিভিন্ন চূড়ান্ত গন্তব্যে যাচ্ছে। এতে সময় সাশ্রয় হচ্ছে ১৫-১৬ দিন, প্রতি কনটেইনারে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ডলার। ইউরোপের মতো ইউএসএ রুটে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল সেবা চালু করতে কোনো প্রতিষ্ঠান আগ্রহী হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে।’
বন্দর চেয়ারম্যানের বক্তব্য প্রদানের আগে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান। সভায় বন্দরের বোর্ড সদস্য, পরিচালক, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০ ফুট দীর্ঘ ৩১ লাখ ৪২ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। জেনারেল কার্গো ওঠানামা হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লাখ টন। জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪ হাজার ৩৬১টি।