সুপ্রভাত ডেস্ক »
বাংলাদেশে অচিরেই সুদের হার বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেছেন, এখনকার সাড়ে আট শতাংশ থেকে আগামী এক-দু’দিনের মধ্যেই এ হার বাড়িয়ে নয় শতাংশ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে, এবং আগামী মাসগুলোতে সেটি ১০ শতাংশ বা তারও বেশি বাড়ানো হবে।
বিবিসিকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. মনসুর।
তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী মাসগুলোতে এই হার ক্রমে বাড়ানো হবে। ‘এটাকে আমরা প্রথমে নয়, তারপর সাড়ে নয়, তারপর দশে নিয়ে যাব। এটা করতে আড়াই মাস সময় লাগবে।’
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে রেমিটেন্স কমে যাওয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পোশাক রপ্তানি খাত বাজেভাবে প্রভাবিত হওয়ায় বাংলাদেশি মুদ্রাও চাপের মধ্যে রয়েছে। খবর বিবিসি বাংলা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধসে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে দেশটিকে চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেয়ার কথা জানায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সেক্ষেত্রে মুদ্রানীতি কঠোর করা ও বিনিময় হার নমনীয় রাখার শর্ত দেয় সংস্থটি।
ড. মনসুর জানান, এই অর্থকে আরও তিন বিলিয়ন ডলার ‘বাড়ানো’ এবং ‘শুরুতেই বেশি দেয়ার জন্য’ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অতিরিক্ত দেড় বিলিয়ন ডলার এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির থেকে এক বিলিয়ন ডলার করে চাইছে।
এ মাসের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যত হওয়ার আগে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ও কারফিউও দামের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গভর্নরের পরিকল্পনা
আইএমএফ-এ তিন দশক কাটানো প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ড. মনসুরকে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
বিগত সরকারের সাম্প্রতিক পতনের পর একই সুতোয় গাথা আমলাতান্ত্রিক প্রস্থানের অংশ হিসেবে পদত্যাগ করেন সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ও অন্য দুই ডেপুটি গভর্নর।
গভর্নর হবার পর ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র বাংলাদেশ ব্যাংকের সদর দপ্তর থেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. মনসুর জোর দিয়ে বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতকে সাজানোকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন তিনি।
দায়িত্ব নেয়ার পর বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে অনেকটা সফল হয়েছেন বলেও জানান গভর্নর। বিশেষ করে ‘অগাস্ট মাসের বিপ্লবের সময় ডলারের বিনিময় মূল্য কমে ১২৫’এ চলে গেলেও এখন তা পুনরায় আগের দামে ফিরেছে’ বলেও দাবি করেন তিনি।
এসময় সুদ হার নীতি ও বিনিময় হার নীতি নিয়েও আলাপ করেন ড. মনসুর।
‘ইন্টারেস্ট রেইট পলিসি (সুদ হার নীতি) আমরা লিবারালাইজ করে দিয়েছি। বাজারকে বলে দিয়েছি, তারা সুদ হার নির্ধারণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হস্তক্ষেপও করা হবে না’, বলেন তিনি।
সুদের হার বেশি হলে সেটি টাকার মূল্য ধরে রাখতে সাহায্য করবে বলেও উল্লেখ করেন নতুন এই গভর্নর।
তিনি বলেন, ‘উচ্চ ইন্টারেস্ট রেটের কারণে টাকা ডলারের চাইতে এট্রাক্টিভ (আকর্ষণীয়) হবে এবং এটা হচ্ছে’।
‘একই এক্সচেঞ্জ রেটে আমরা ডলার কিনতে পারছি বাজার থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে যেখানে আমরা বিলিয়ন ডলার হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেখানে আমরা অল্প হলেও কিছু ডলার কিনে ফেলেছি ইতিমধ্যে’। একে ইতিবাচক সংকেত বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
এসময় অতীতের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকার বা কোনো ব্যাংককে অর্থ দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
একইসঙ্গে আর্থিক খাতে ভারসাম্য আনতে দুইভাবে ‘সাপোর্ট’ দেয়ার কথা জানান তিনি।
প্রথমত কৃষি ও শিল্প খাতের জন্য সব কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে এবং দ্বিতীয়ত ‘মনিটরি পলিসিকে টাইট ফিস্টে (শক্ত মুষ্টিতে)’ রাখা হবে, বলেন ড. মনসুর। এর মাধ্যমে ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে ‘উল্লেখযোগ্য ফলাফল’ পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বলেন, ‘আমি আশা করছি, (মূল্যস্ফীতি) ছয়-সাতের মধ্যে নিয়ে আসতে পারবো এবং পরবর্তীতে আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা হচ্ছে আমি মূল্যস্ফীতিকে তিন-চার শতাংশে নামিয়ে আনবো’।
ব্যাংক খাতের অনিয়ম বন্ধে যে পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে
‘পরিকল্পিতভাবে আর্থিক ব্যবস্থার ডাকাতি’ ব্যাংকগুলোর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে এবং পুঁজিবাজার ও বৃহত্তর অর্থনীতিতে গুরুতর প্রভাব ফেলেছে বলে সাক্ষাৎকারে জানান ড. আহসান এইচ মনসুর।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে জড়িত ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর খেলাপি ঋণের পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ পাচার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থ পাচার ছিল ‘একবারে ব্যাংকের ডাকাতি। তারা টাকা নিয়ে সিঙ্গাপুর, দুবাই, লন্ডনসহ অন্যত্র রেখেছে। তাই প্রথম প্রচেষ্টা হবে লোকেদের নিয়ে কাজ করা এবং অর্থ ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করা,’ বলেন ড. মনসুর।
সেক্ষেত্রে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে বিশ্বব্যাংকের সাথে আলোচনার কথা জানান তিনি।
বলেন, বিশ্বব্যাংকের সাপোর্ট ইউনিটের সঙ্গে আলোচনা করে আন্তর্জাতিক আইন এবং অর্থ পাচার হওয়া দেশের ও নিয়ম-নীতি মেনে ‘টাকা এবং ব্যক্তিকে ফেরত’ আনার বিষয়ে চেষ্টা করা হবে। তবে একে সময়সাপেক্ষ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোকে স্থিতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলেও জানান ড. মনসুর। সেজন্য পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনসহ কিছু পদেক্ষেপের কথা জানান তিনি।
‘তারা লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে চলে গেছেন। সেটা ছাপাতে গেলে মূল্যস্ফীতি ঠিক হবে না আবার ম্যাক্রোস্ট্যাবিলিটি নষ্ট হয়ে যাবে। কাজেই সেটা করতে পারবো না। আমাদের সীমিত পরিসরে ধীরে ধীরে এই রিস্ট্রাকচারিং করতে হবে এবং অর্থের যোগানও করতে হবে’, বলেন তিনি।
‘এটি করার সময় সমান্তরালভাবে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে। তাই আমরা একটি ব্যাংকিং কমিশন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি’।
এই কমিশনের কাজ হবে ব্যাংকগুলোর একটি বিস্তৃত অডিট করা এবং বোর্ড পরিবর্তন, ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন, নতুন পুঁজি যোগ করা অথবা কিছু ছোট ব্যাংকের ক্ষেত্রে একীভূতকরণের মতো প্রতিকারের পরামর্শ দেয়া।
‘আমাদের আল্টিমেট অবজেক্টিভ হচ্ছে আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা করা, বিনিয়োগকারীদের নয়। যারা বিনিয়োগের নামে ব্যাংকগুলোকে লুট করেছে, তাদেরকে চিরতরে এই সিস্টেম থেকে বিদায় করবো। সেটা আমাদের কৌশল’, বলেন তিনি।
ড. মনসুর ধারণা করছেন, কিছু ইসলামী ধারার ব্যাংককে সরকারের আরও ১৫ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার পুঁজি দিতে হবে, যার অর্থ হতে পারে কার্যত তাদের জাতীয়করণ করে ফেলা।
‘আমরা এটা চাই না.. কিন্তু [একটি] এরা অনেক ঋণ করেছে, আর তা ফেরতও দিতে যাচ্ছে না… আমাদের অন্তত আমানতকারীদের অর্থ পূরণ করতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।
‘আমরা চাই প্রতিষ্ঠান টিকে থাকুক’
কোনো ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, ‘এই সরকার এবং আমরা ব্যাংকিং খাত থেকে কোনো বিজনেসের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেইনি, ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিয়েছি। তাদের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছি। আমরা চাই প্রতিষ্ঠান টিকে থাকুক’।
তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিকানা পরিবর্তন করতে হতে পারে বলে জানান তিনি। বিশেষ করে কারো যদি ‘অনেক লায়াবিলিটি থাকে’ তবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সেই সম্পত্তিগুলো থেকে হয়তো সরকারি অর্থ উদ্ধার করতে হবে।
‘হয়তো এক-দুজন ঘনিষ্ঠভাবে এখানে অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের হয়তো চাকরীচ্যুত করা হতে পারে। কিন্তু আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে দেবো না। সব প্রতিষ্ঠান আগের মতো চলবে’, বলেন তিনি।
মুদ্রানীতিতে সংস্কারের পাশাপাশি চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও নতুন সরকার কঠোরভাবে ব্যয় কমানোর ঘোষণা দেবে বলে ধারণা করছেন ড. মনসুর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ব্যয় কমিয়ে দেশের রাজস্ব ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা চার দশমিক ছয় শতাংশে নামিয়ে আনে – যা ব্লুমবার্গের তথ্যমতে, ২০১৫ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন।
তবে বাজেটের ব্যয়ে আরও ৯ থেকে ১০ শতাংশ কমাতে হবে ‘যাতে বেসরকারি খাতের জন্য আরও বেশি ঋণ পাওয়া যায়’, বলেন ড. মনসুর।
গত সপ্তাহের শেষের দিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কূটনীতিকদের এক সমাবেশে বলেছিলেন, তার সরকার আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে ‘বিস্তৃত সংস্কার’ করবে।
নির্বাচনের আগে কতটা সময় লাগতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মনসুর বলেন, আরও তিন বছর বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।