নিলা চাকমা »
ইমেজিং এর মাধ্যমে রোগ শনাক্ত করার পদ্ধতির নাম রেডিওলোজি। এটি ছাড়া জটিল রোগ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগে এমআইআর, সিটিস্ক্যানসহ সর্বমোট ১৭টি রোগ নির্ণয়ের মেশিন রয়েছে। সেখান থেকে ৮টি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অচল। সেই মেশিন ঠিক করার কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। অথচ একই বিভাগের জন্য কোটি কোটি টাকায় গড়ে উঠছে নতুন ভবন। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে এ নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে।
জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগে বর্তমানে এক্সরে ৬টি , মেমোগ্রাফি ১টি, ওপিজি ১টি, এমআরআই ২টি, সিটি স্ক্যান ২টি, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ৬টিসহ ১৭টি মেশিন রয়েছে। তার মধ্যে মোমোগ্রাফি ও ওপিজি, আল্ট্রাসোনোগ্রাফির ১টি, এমআরআইয়ের ২টি, সিটি স্ক্যানের ১টি দীর্ঘদিন ধরে অচল রয়েছে। যার ফলে অসংখ্য রোগীদের বাড়তি দাম দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগ নির্ণয়ের জন্য যেতে হচ্ছে। ফলে অনেকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে এমআরআই করাতে অনেক খরচ। চমেক হাসপাতালে এমআরআই করতে যেখানে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়; সেখানে প্রথম শ্রেণির বেসরকারি হাসপাতালে সর্বনি¤œ ৯ হাজার টাকা দিতে হয়।
অথচ সেই এমআরআই মেশিন অকেজো হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে ৩ বছরের বেশি সময় সেবা থাকে বন্ধ চমেক হাসপাতালে। তবে ২০১৭ সালে চমেক হাসপাতালে নতুন একটি এমআরআই মেশিন বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইনস্টলেশন শেষে ওই বছরের ২৪ অক্টোবর এ মেশিনের সেবা উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু উদ্বোধন হলেও ফিল্মের অভাবে ওই সময় পুরোদমে মেশিনটির সেবা চালু করা যায়নি। পরে টেন্ডারের মাধ্যমে ফিল্ম কেনার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে পুরোদমে সেবা চালু হয়। কিন্তু সেবা চালুর তিন বছর না যেতেই যান্ত্রিক ক্রটির কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে অচল হয়ে পড়ে মেশিনটি। ফের দীর্ঘসময় এমআরআই সেবা বন্ধ থাকে চমেক হাসপাতালে। পরে ২০২১ সালের মে মাসে সার্ভিসিংয়ের মাধ্যমে মেশিনটি সচল করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড। ওই সময় মেশিনটি সার্ভিসিং বাবদ সাড়ে ৯ লাখ টাকা বিল করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে মাস না যেতেই ফের অকেজো হয়ে পড়ে এমআরআই মেশিন। এভাবে সর্বশেষ ২০২২ সালের ১০ মে থেকে একেবারে অচল হয়ে আছে মেশিনটি। আর এটি ঠিক করতে একটি যন্ত্রাংশের জন্যই খরচ হয় ৫৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। অথচ এই টাকা খরচ করেও সচল করা হয়নি মেশিন। আরও একটি যন্ত্র লাগানোর জন্য ৪০ লাখ টাকা প্রয়োজন।
রোগ পরীক্ষা নিয়ে ভোগান্তি প্রসঙ্গে হাঁড় ক্ষয়ে যাওয়া এক রোগী সোলেমান রহমান বলেন, ‘আমি সামান্য বেতনের সরকারি কর্মকর্তা। আমার রোগের বিষয়ে চিকিৎসককে দেখালে তিনি এমআরআই করাতে বলেন। কম খরচের কথা শুনে চমেক হাসপাতালে যখন যায় সেখানে শুনি মেশিন নষ্ট। পরে বাধ্য হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই করাতে হয়। বিরাট অংকের টাকা সেখানে চলে যায়। চমেক হাসপাতালে এমআরআই করাতে পারলে কম ভোগান্তি ও খরচও কম লাগত। আমাদের মতো গরীব রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দ্রুত মেশিন ঠিক করলে ভালো হয়।’
এদিকে রেডিওলোজি বিভাগের সেবা প্রসারিত করতে ৯শ কোটি ২৪ লাখ ৬ হাজার টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে চমেক হাসপাতাল। হাসপাতালের পেছনে মাঠের পাশে গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে। প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ঠিকাদারিতে রয়েছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড এবং গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি (জেবি) লিমিটেড। প্রকল্পে ঋণ প্রদান করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সি (জাইকা)।
৫ তলা এই ভবনটিতে থাকবে ২টি এমআরআই, ২ সিটি স্ক্যান, ৪টি এক্সরে, ১০টি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, ১টি মেমোগ্রাফি, ১টি গেস্ট্রোগ্রাফি, ১টি ক্যাথ ল্যাব, ২০টি এনজিওগ্রাম। বর্তমানে রেডিওলোজি বিভাগে যেকটি সচল মেশিন রয়েছে তা দিয়ে- সিটিস্ক্যান(সকাল ৮টা-রাত ৯টা) প্রতিদিন ৫০জন, এক্সরে (সকাল-বিকাল) ৫০০ জন, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি (সকাল ৮টা-দুপুর আড়াইটা) ৬০ জনের মতো রোগীর পরীক্ষা করানো হয়। নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তিনগুন রোগীদের চিকিৎসেবা দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা হয় চমেক হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুভাষ চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে যে হারে রোগী আসে তার জন্য একটা বড় অবকাঠামো দরকার ছিলো। আর তা আমরা পাচ্ছি। কিন্ত সবচেয়ে যেটি বেশি দরকার তা হলো লোকবল। নতুন মেশিন আসবে; রোগ পরীক্ষা করবে কে? তার জন্য দরকার দক্ষ জনবল। এছাড়া চমেক হাসপাতালে কোনো বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নেই। ঢাকা থেকে ইঞ্জিনিয়ার আসলে মেশিন ঠিক করানোর কাজ শেষ হয়। তাই শুধু অবকাঠামো এবং মেশিন দিয়ে চিকিৎসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জনবল বৃদ্ধি, দক্ষ জনবল, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পেলে রোগ নির্ণয়ে চমেক হাসপাতাল অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘নতুন ভবনটি জাইকার ঋণে করা হচ্ছে। আমাদের রেডিওলোজি বিভাগের অচল মেশিন মেরামতের জন্য কার্যক্রম সবসময় চলমান রয়েছে। কিছুদিন আগে ৫টি এক্সরে মেশিন ঠিক করা হয়েছে। একটি সিটি স্ক্যান ঠিক করার কোনো সুযোগ নেই। এরকম কিছু মেশিন আছে, যেগুলো কোনোদিন ঠিক হবে না। সেগুলো সরকার অকার্যকর ঘোষণা করার পর টেন্ডার আসলে বিক্রি করা হয়। সেই কার্যক্রম চলছে।
এমআরআই মেশিন মেরামতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গত বছরে মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড ৫৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকার একটা যন্ত্রাংশ লাগিয়ে যায়। সম্পূর্ণ ঠিক করতে দরকার আরও ৪০ লাখ টাকা। কোম্পানিটির সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি অনুয়ায়ী করমূল্যের ৬.৫ শতাংশ দিতে হয়। তারা বর্তমানে ১০ শতাংশের উপরে চাইছে। যার জন্য কম্পিয়নশিপ মেইনটেনেস কমপ্লেক্স (যন্ত্রাংশ সংরক্ষণ ও মেরামত সংক্রান্ত চুক্তি) হচ্ছে না। সেটি হলে মেশিনটি কোম্পানি নষ্ট হওয়া মাত্র ঠিক করবে। তার জন্য মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিবছর চাইছে ৯৪ লাখ ৫০ হাজার। যদি চুক্তি অনুযায়ী ৬.৫ শতাংশ হয় তাহলে ৬৩ লাখ টাকা দিতে হতো। কিন্ত তারা ২৯ লাখ টাকা বেশি দাবি করছে। কিন্তু সরকার এত বাড়তি টাকা দিতে চাইছে না। যার জন্য সচলও হচ্ছে না। আদৌ হবে কিনা আমরা জানি না। এটা সম্পূর্ণ সরকারের সিদ্ধান্ত।’
নতুন ভবনে জনবল নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবস্থা আধুনিকায়ন প্রকল্পটি পুরো দেশের আট বিভাগে হচ্ছে। আশা করি, জনবল সেভাবে নিয়োগ করা হবে।’