বাণিজ্যিকভাবে লিন্ডে ও স্পেকট্রার পাশাপাশি বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করছে আবুল খায়ের ও মোস্তফা হাকিম গ্রুপ
কোভিড ও নন-কোভিড শ্বাসকষ্টের সব রোগীর জন্যই লাগছে অক্সিজেন-চিকিৎসকবৃন্দ
ভূঁইয়া নজরুল »
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে করোনা মহামারির আগে দিনে ২০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়েই রোগীদের চাহিদা মেটানো হতো। অনেক সময় এই ২০টি সিলিন্ডারও শেষ হতো না। কিন্তু এখন এ হাসপাতালে দিনে ৮০টি সিলিন্ডারের প্রয়োজন হয়। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট, মা ও শিশু হাসপাতালেও আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। এসবের সাথে এখন যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালসহ নতুনভাবে গড়ে উঠা আইসোলেশন সেন্টারগুলোর পাশাপাশি বাসাবাড়িতে ব্যক্তি উদ্যোগে ব্যবহার করা অক্সিজেন সিলিন্ডার। এতে সবমিলিয়ে আগের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি অক্সিজেন লাগছে।
করোনা রোগীদের প্রধান চিকিৎসা হিসেবে অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। এবিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘করোনার প্রধান ওষুধ অক্সিজেন। তাই আমাদের অক্সিজেন অনেক বেশি লাগছে। নতুন করে অক্সিজেনের লাইন বাড়ানো হয়েছে। করোনা ওয়ার্ডের পাশাপাশি করোনা উপসর্গ নিয়ে যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের জন্যও পাইপের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ দিতে লাইন বর্ধিত করা হয়েছে। কারণ সিলিন্ডারের অক্সিজেন দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তাই পাইপলাইনে অক্সিজেন থাকলে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেয়া যায়।’
তিনি আরো বলেন, সিলিন্ডারগুলোর প্রেসার ধীরে ধীরে কমে যায়। কিন্তু রোগীর তো বেশি প্রেসারে অক্সিজেন দিতে হয়। সেজন্য বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্টের ট্যাংকে এবং সিলিন্ডারে অক্সিজেন সরবরাহ করে লিন্ডে বাংলাদেশ ও স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড নামের দুটি কোম্পানি। এবিষয়ে লিন্ডে বাংলাদেশের মুখপাত্র মুশফিক আকতার বলেন, ‘আমরা সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করি এবং তা আগের চেয়ে অবশ্যই অনেক বেশি। তবে কী পরিমাণ দিচ্ছি তা আপনাকে (মিডিয়াকে) বলা আমাদের কোম্পানির নিষেধ রয়েছে।’
অপর কোম্পানি স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালগুলোতে গত মার্চে আমরা দিনে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ঘনমিটার অক্সিজেন সরবরাহ করলেও এখন প্রায় ১৮ হাজার ঘনমিটার সরবরাহ করা হচ্ছে। আর এটি করা হচ্ছে সিলিন্ডারের মাধ্যমে।’
করোনায় অক্সিজেন কী পরিমাণ ব্যবহার হয় তার একটা পরিসংখ্যান দেন বন্দর-পতেঙ্গা-ইপিজেড করোনা হাসপাতালের প্রধান সমন্বয়ক ডা. হোসেন আহমেদ। তিনি বলেন, একজন রোগীর অক্সিজেন সিচুরেশন লেভেল ৯৫ থেকে ৯৮ থাকলে আমরা তাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেই। এখন কোনো রোগীর অক্সিজেন মাত্রা এর চেয়ে নিচে নেমে গেলে স্বাভাবিক লেভেলে পৌঁছাতে কখনো কখনো ১০ লিটার থেকে ৬০ লিটার অক্সিজেনও প্রয়োজন হয়। আর যখন তা পৌছানো যায় না, তখনই ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। আর সেজন্যই এখন অনেক বেশি অক্সিজেন লাগছে।
মাঠ পর্যায়ে রোগীদের ঘরে ঘরে অক্সিজেন সরবরাহ করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এদের মধে অক্সিজেন শেয়ারিং ফর বাংলাদেশ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির একজন হলেন ডা. মহিউদ্দিন মাসুম। তিনি বলেন, ‘আমরা রোগীদের ঘরে গিয়ে অক্সিজেন পৌঁছে দিয়ে আসছি। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী একটি নির্ধারিত মাত্রায় রোগীরা ঘরে এই অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। নগরীতে দিন দিন অক্সিজেন ব্যবহারের হার বাড়ছে। অপরদিকে হাসপাতালের তুলনায় রোগীরা ঘরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বলে অনেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ না হলে হাসপাতালমুখী হচ্ছে না।’
কোভিড ও নন-কোভিড উভয় ধরনের রোগীর জন্য এখন অক্সিজেন ব্যবহার বাড়ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, ‘করোনা চিকিৎসার আগে শুধুমাত্র মুমুর্ষ রোগীদের ক্ষেত্রে অক্সিজেন ব্যবহার হতো। আর এতে স্বভাবতই অক্সিজেন কম লাগতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, কোভিড ও নন-কোভিড সব রোগীর ক্ষেত্রে অক্সিজেন লাগছে। কেউবা স্বাভাবিক শ্বাসকষ্ট, আবার কেউবা করোনার কারণে শ্বাসকষ্ট। তখন অক্সিজেন ছাড়া উপায় থাকে না।’
উল্লেখ্য, নগরীর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড (নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ থাকা বেড) না থাকায় অক্সিজেনের অভাবে অনেক রোগী মারা যাচ্ছে। কেউবা হাসপাতালে বেড না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে, আবার কেউবা বাসায় নিয়ে যাচ্ছে সিলিন্ডার।
এতো অক্সিজেন কোথা থেকে আসছে?
চট্টগ্রামে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য চারটি কোম্পানির অনুমোদন ছিল। এগুলো হলো- লিন্ডে, স্পেকট্রা, ইসলাম এবং বিআইডিএল। এদের মধ্যে ইসলাম ও বিআইডিএল কোম্পানি দুটি ঢাকার, চট্টগ্রামে তাদের কোনো প্ল্যান্ট নেই। সেজন্য এই করোনাকালে চট্টগ্রামে লিন্ডে ও স্পেকট্রা অক্সিজেন সরবরাহ করছে। এই দুই কোম্পানির পাশাপাশি বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করতে আবুল খায়ের গ্রুপ ও সাবেক মেয়র মনজুর আলমের পারিবারিক দাতব্য সংস্থা মোস্তফা হাকিম গ্রুপ এগিয়ে এসেছে।
এবিষয়ে কথা হয় আবুল খায়ের গ্রুপের মানব সম্পদ বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মোহাম্মদ ইমরুল কায়েস ভূঁইয়ার সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত শিল্পের জন্য অক্সিজেন উৎপাদন করি। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিকালে আমরা একটি প্রযুক্তির মাধ্যমে মানব শরীরের ব্যবহারের জন্য সীমিত আকারে অক্সিজেন উৎপাদন করছি। ৩০০ সিলিন্ডারের মাধ্যমে প্রতিদিন নগরীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে আমরা অক্সিজেন সরবরাহ করে আসছি।’
অপরদিকে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক নিপুর চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বেঙ্গল অক্সিজেন লিমিটেডে শিল্প কাজের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অক্সিজেন উৎপাদন করি। তবে এখন এই দুর্যোগ মুহূর্তে মেডিক্যাল অক্সিজেনও উৎপাদন করে বিনামূল্যে মানুষের মধ্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল এবং ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম রয়েছে। তবে এসব হাসপাতাল নিজে অক্সিজেন উৎপাদন করে না। অক্সিজেন সরবরাহকারী দুই কোম্পানি স্পেকট্রা ও লিন্ডে ট্যাংকে তরল অক্সিজেন সরবরাহ করে, সেই অক্সিজেনকে গ্যাসে কনভার্ট করে পাইপের মাধ্যমে রোগীদের দেয়া হয়। একইসাথে সিলিন্ডারের মাধ্যমেও অক্সিজেন সরবরাহ হয়ে আসছে।