বছরে ৩.৩৬ মিলিয়ন বজ্রপাত, প্রাণ হারায় ৩৫০ জন

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩.৩৬ মিলিয়ন বজ্রপাতের ঘটনায় প্রায় ৩৫০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই কৃষক, শ্রমজীবী ও খোলা জায়গায় অবস্থানকারী মানুষ বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, দেশে বজ্রপাত এখন আর কেবল একটি প্রকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি এক নীরব ঘাতক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাতের তীব্রতা ও ঘনত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে প্রাণহানিও। অথচ অধিকাংশ মানুষই বজ্রপাতের সময় কী করতে হবে বা কোথায় আশ্রয় নিতে হবে- তা জানেন না।

শনিবার (২৮ জুন) আন্তর্জাতিক বজ্রপাত নিরাপত্তা দিবস ২০২৫ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তারা এসব তথ্য জানান।

“শুনলে বজ্রধ্বনি, ঘরে যাই তখনই”- শীর্ষক বার্তাকে সামনে রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান এইড অপারেশনস’র অর্থায়নে পরিচালিত “সুফল আইআই” প্রকল্পের আওতায় এই আয়োজন করে কেয়ার বাংলাদেশ। এতে অংশীদার হিসেবে ছিল কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড, রাইমস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)।

কারিগরি অধিবেশনে আঞ্চলিক দুর্যোগ সহযোগী সংস্থা- রাইমস’র আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ খান মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী একটি বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনা দেন। তিনি তার উপস্থাপনায় জানান, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩.৩৬ মিলিয়ন বজ্রপাত ঘটে, যার ফলে প্রাণ হারান প্রায় ৩৫০ জন মানুষ। এসব প্রাণহানির মধ্যে অধিকাংশই ঘটে খোলা মাঠে অবস্থানরত কৃষক, শ্রমজীবী ও শিশুদের মধ্যে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মধ্যে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেট জেলা বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষ করে এপ্রিল ও মে মাসে বজ্রপাতের ঘনত্ব ও তীব্রতা সর্বাধিক থাকে, যা বর্ষা-পূর্ব গ্রীষ্মকালীন বজ্রঘন বায়ুপ্রবাহের ফল।

তিনি আরও জানান, জনসচেতনতা ও প্রস্তুতির অভাবই বজ্রপাতজনিত প্রাণহানির অন্যতম কারণ। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় মোট ১,৭৫০ জন- যাদের মধ্যে নারী, শিশু ও কৃষকরা অন্তর্ভুক্ত- তাদেরকে বজ্রপাতের সময় নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ, সময়োপযোগী সাড়া প্রদান এবং সচেতন আচরণবিধি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বিগত কয়েক দশকে আমরা ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার ক্ষেত্রে আগাম সতর্কবার্তা, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পেরেছি। কিন্তু বজ্রপাতজনিত মৃত্যু একটি নীরব সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৩৫০ জন মানুষ বজ্রপাতে মারা যান, যাদের মধ্যে অধিকাংশই খোলা মাঠে থাকা কৃষক, শিশু ও শ্রমজীবী মানুষ। এই মৃত্যুগুলো প্রতিরোধযোগ্য।

তিনি বলেন, আগাম সতর্কতা, সঠিক বার্তা এবং জনআচরণে পরিবর্তন আনতে পারলেই প্রাণহানি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। ‘শুনলে বজ্রধ্বনি, ঘরে যাই তখনই’- এই বার্তাটি শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি জীবন রক্ষার হাতিয়ার। আমরা চাই, এই বার্তা প্রত্যেক মানুষের মগজে ও হৃদয়ে গেঁথে যাক। আগামী দিনে এই দিবসকে সরকারিভাবে আরও বড় পরিসরে উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

রাইমস-এর কান্ট্রি প্রোগ্রাম লিড মো. রায়হানুল হক খান বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে বজ্রপাতের মতো স্বল্পমেয়াদী কিন্তু প্রাণঘাতী দুর্যোগের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্বাভাস থাকলেও সঠিক বার্তা সঠিক সময়ে মানুষের কাছে না পৌঁছানোয় অনেক সময় বিপদ এড়ানো যায় না। এজন্য আমরা বিএমডি’র সঙ্গে যৌথভাবে যে ‘নাউকাস্টিং সিস্টেম’ তৈরি করেছি, সেটিকে টেকসই ও নিয়মিত ব্যবহারের অংশ করার জন্য সরকারকে আহ্বান জানাই। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বজ্রপাত নিরাপত্তা দিবস যেন প্রতি বছর সরকারিভাবে পালিত হয়, সেই উদ্যোগও প্রয়োজন। এই দিবসের মাধ্যমে আমরা যে বার্তা দিতে চাই, তা হলো- বজ্রপাত থেকে বাঁচা সম্ভব, যদি আমরা প্রস্তুত থাকি।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ও স্লোগান প্রস্তাবক খান মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩.৩৬ মিলিয়ন বজ্রপাত হয়। এপ্রিল ও মে মাসে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আমাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর হার বেশি সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেটে। কারণ এসব এলাকায় খোলা জায়গায় কাজ করার প্রবণতা বেশি। কিন্তু ভয়ঙ্কর এই দুর্যোগ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত।

তিনি বলেন, আমরা যদি স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বজ্রপাত বিষয়ে শিক্ষাদান শুরু করি, জনপদ পর্যায়ে বার্তা পৌঁছে দেই, তাহলে এই মৃত্যু রোধ সম্ভব। আমরা ইতোমধ্যে তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় ১,৭৫০ জন কৃষক, নারী ও শিশুকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাদের মধ্যে আমরা ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত পেয়েছি। এটি আমাদের সামনে একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে।

এসময় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম কামরুল হাসান বলেন, “বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া একসময় প্রায় অসম্ভব কাজ মনে হতো। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আমরা এখন পরীক্ষামূলকভাবে ‘নাউকাস্টিং’ প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদী পূর্বাভাস দিতে পারছি। এপ্রিল ২০২৫ থেকে আমরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ, হোয়াটসঅ্যাপ ও প্রি-রেকর্ডেড ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে জনগণের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন, সুফল আইআই প্রকল্পের সহায়তায় এটি আমরা মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থাকে জাতীয় পর্যায়ে আরও বিস্তৃত করা হবে। আমাদের লক্ষ্য, শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকেও যেন এই বার্তা সময়মতো পৌঁছে দেওয়া যায়।

এরপর অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, এতে অংশ নেন— দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আহমদুল হক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান, আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমেনুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উর্মি আহসানসহ আরও অনেকে। তাঁরা আলোচনায় বজ্রপাত সচেতনতাকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি, সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে জনসম্পৃক্ত বার্তা তৈরির গুরুত্ব তুলে ধরেন।

এই আয়োজনের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উদ্যোগের সূচনা হলো, যেখানে অংশ নিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, আবহাওয়া অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ব্রি, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, যুব সংগঠন এবং শিক্ষার্থীরা।