জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত এক যুগে বাংলাদেশের সড়কে ঝরে গেছে এক লাখ ১৬ হাজারেরও বেশি প্রাণ, যা বর্তমান বিশ্বের দুটি ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্র—ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে মোট নিহতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের সড়কের এই ভয়াবহ চিত্রকে ‘সড়কে গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
তাদের প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোট ৬৭ হাজার ৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত এবং এক লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন আহত হয়েছেন। তবে হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি হতে পারে বলে দাবি করে তারা। একই সময়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে (গাজায়) নিহতের সংখ্যা ৬৭ হাজার এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে প্রায় ৪৫ হাজার জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতার আগে দেশে নৌ ও রেলপথ ছিল নিরাপদ ও স্বল্পব্যয়ী প্রধান বাহন। তখন মোট যাতায়াতের ৮০ শতাংশই হতো নৌ ও রেলপথে, আর সড়কে চলাচল করত মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ। ফলে সড়ক দুর্ঘটনাও সীমিত ছিল ওই ২০ শতাংশের মধ্যেই।’ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা সচরাচর উল্লেখ করা হয় না।
সেখানে আরও বলা হয়, ‘স্বাধীনতার পর দাতা সংস্থার নির্দেশনা ও সরকারের ভুল নীতির কারণে একের পর এক সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়। এতে শুরু হয় বেহিসেবি লুটপাট ও সড়কে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। বহুমাত্রিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার বদলে নতুন নতুন সড়ক নির্মাণে জোর দেওয়ায় এখন ৮০ শতাংশ মানুষ সড়কপথে যাতায়াত করছে। এর ফলে সড়ক দুর্ঘটনাও ৮০ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সাধারণ সম্পাদক
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পরেও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের নীতি ও কৌশলে কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় এহেন দুর্ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। ফলে সড়কে গণহত্যা বন্ধ, যানজট ও দুর্ঘটনা কমানো কিংবা সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যমান অগ্রগতি ঘটেনি। সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা গেলে এই খাতে বাস্তব অগ্রগতি সম্ভব নয়।’
অনুষ্ঠানে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ১২ দফা সুপারিশ তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে— নিরাপদ ও স্বল্পব্যয়ী নৌ ও রেলপথ পুনরুজ্জীবিত করে সড়কের সঙ্গে সমন্বিত যাতায়াত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, সড়ক পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা, মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটানো, এবং পুরো পরিবহন খাতকে আপাদমস্তক সংস্কার করা।
এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, সড়ক দুর্ঘটনার এমন ভয়াবহ চিত্র দেখেও আমাদের বোধোদয় হচ্ছে না। আমরা জানি না, আর কত মৃত্যু হলে সড়কপথের এই ‘গণহত্যা’ বন্ধ হবে।