সুপ্রভাত ডেস্ক »
মরিচ, হলুদ ও অন্যান্য মশলাগুলি প্রায়শই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে দাবি করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, এগুলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু এই সকল মশলা কি সত্যিকার অর্থেই আমাদের খাবারে কোন স্বাস্থ্য উপকারিতা যোগ করতে পারে কি-না; সেটি নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। খবর বিবিসির।
মশলা হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের খাদ্যের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খাবারে মরিচ একটু গুঁড়ার ব্যবহার, চায়ের মাঝে আদার ব্যবহার ইত্যাদি যেন খুবই সাধারণ। এছাড়াও সম্প্রতি আরও কিছু মশলা দৈনন্দিন খাবার-দাবারে বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে।
হিলারি ক্লিনটন অসুস্থতা এড়াতে ২০১৬ সালে প্রচারণা চলাকালীন মরিচ খেতেন বলে কথিত আছে। সহস্রাব্দ ধরে এশিয়ায় ব্যবহৃত হলুদ এখন বড় বড় কফিশপের খাবারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি মহামারি চলাকালীন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এটি কার্যকরী বলে প্রচারণা চালানো হয়েছে।
মরিচের উপকারিতা
সবচেয়ে পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত মশলাগুলির মধ্যে একটি হল মরিচ। সময়ের পরিক্রমায় নানা গবেষণায় স্বাস্থ্যের উপর এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই ফলাফলে পাওয়া গিয়েছে।
মরিচের প্রধান সক্রিয় উপাদান ক্যাপসাইসিন। যখন আমরা মরিচ খাই তখন ক্যাপসাইসিনের অণুগুলি দেহের তাপমাত্রার সাথে সংশ্লিষ্ট রিসেপ্টরের সাথে যোগাযোগ করে। তখন তাপের অনুভূতি তৈরি করতে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠানো হয়।
কিছু গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, ক্যাপসাইসিন আপনাকে দীর্ঘকাল বাঁচতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, ২০১৯ সালে ইতালিতে করা এক গবেষণায় দেখা যায় যে, যারা মরিচযুক্ত খাবার সপ্তাহে চারবার খেয়েছেন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি যারা কখনও মরিচ খাননি তাদের তুলনায় কম।
২০১৫ সালে চীনের গবেষকরা প্রায় ৫ লাখ চীনা প্রাপ্তবয়স্ক যারা কি-না মরিচ খেয়ে থাকেন তাদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, মরিচ খাওয়ার সাথে মৃত্যুর ঝুঁকি কমার সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, যারা প্রায় প্রতিদিন মশলাদার খাবার খান তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি যারা সপ্তাহে কম মশলাদার খাবার খান তাদের তুলনায় ১৪ ভাগ কম।
এ সম্পর্কে হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের প্রফেসর ও গবেষক লি কিউ বলেন, “গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় যে, মশলাদার খাবার বেশি খাওয়া মৃত্যুহার কমার ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত। বিশেষত ক্যান্সার, হৃদ্রোগ ও শ্বাসযন্ত্রের রোগের কারণে মৃত্যুহার কমাতে কাজ করে।”
তবে এর মানে এই নয় যে, প্রচুর পরিমাণে কাঁচামরিচ খাওয়া শুরু করলে সেটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে কিংবা এটি আপনাকে স্বল্প সময়ের জন্য শ্বাসকষ্ট থেকে রক্ষা করবে।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, চীনের গবেষণায় প্রত্যেককে প্রায় সাত বছর সময় ধরে পর্যালোচনা করা হয়েছিল। তাই তাদের হয়তো মরিচ খাওয়ার সুস্বাস্থ্যকর প্রভাবটি লম্বা সময়ের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে; সপ্তাহ বা মাসের মতো স্বল্প সময়ের মধ্যে নয়।
কিউই বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষার যোগ্যতা, বৈবাহিক অবস্থা, ডায়েট, অ্যালকোহল গ্রহণ, ধূমপান ইত্যাদি জীবনযাত্রার নানা বিষয়গুলি বিবেচনায় এনে দেহে মরিচের প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি মরিচের ফলে দেহে রোগের ঝুঁকি কমার পেছনে ক্যাপসাইসিন প্রভাব রাখতে পারে বলে মনে করেন।
বেশ কয়েকটি গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, ক্যাপসাইসিন দেহে ব্যবহৃত শক্তির পরিমাণ বাড়াতে পারে এবং ক্ষুধা হ্রাস করতে পারে।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক জুমিন শি গবেষণায় দেখান যে, মরিচ গ্রহণের সাথে স্থূলতা ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমতে পারে। তবে যারা অতিরিক্ত পরিমাণে (দৈনিক ৫০ গ্রামের বেশি) মরিচ খেয়ে থাকেন, তাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে যায়। যদিও চীনাদের ওপর করা এই গবেষণার পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।
হলুদের স্বাস্থ্য উপকারিতা
হলুদ আমাদের খাবারে ব্যবহৃত আরেকটি জনপ্রিয় মশলা; যা দেহের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়। এটির মধ্যে উপাদান হিসেবে থাকে কারকিউমিন। যা সাধারণত প্রদাহ, মানসিক চাপ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য বিকল্প ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তবে হলুদ কতটা উপকারী সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যদিও অসংখ্য গবেষণায় কারকিউমিনের ক্যান্সার প্রতিরোধী প্রভাব পাওয়া গেছে। কিন্তু একটি ল্যাবের পরিবেশ থেকে মানুষের দেহ বেশ আলাদা। তাই গবেষকদের মতে এটির জৈব উপযোগিতা খুব বেশি হবে এমন মন্তব্যের সুযোগ নেই।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক পল ফ্রিডম্যান বলেছেন, “পশ্চিমা বিশ্বে বিকল্প ওষুধ হিসাবে হলুদসহ নানা মশলার ব্যবহার মধ্যযুগের শেষের দিকে দেখা গিয়েছিল। যখন মশলা রোগবালাই প্রতিরোধ করতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল।
ফ্রেডম্যান বলেন, “মশলার প্রতি আমাদের আধুনিক ঝোঁক ৫০ বছর আগের তুলনায় মধ্যযুগীয় সময়ের দিকে বেশি পাওয়া যায়। যা বর্তমানের ওষুধ (অ্যান্টিবায়োটিক) ও অতীতের কুসংস্কারের মাধ্যমে তৈরি ওষুধের মধ্যবর্তী সময়।”
এদিকে ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার সাবেক গবেষণা সহকারী অধ্যাপক ক্যাথরিন নেলসন দেহে কারকিউমিনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। এক্ষেত্রে তার ফলাফলে দেখা যায় যে, কারকিউমিন জৈবিক দিক থেকে ততটা কার্যকরী নয়। কেননা এটি হজম হয়ে গেলে আর কার্যকরী থাকে না। একইসাথে কারকিউমিন অন্ত্রে প্রোটিনের সাথে যুক্ত হলে গঠন পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন দেহে এর প্রভাব সামান্যই মনে হয়।
ক্যাথরিন মনে করেন, হলুদ হয়তো উপকারী হতে পারে। তবে সেটা কারকিউমিনের কারণে নয়। এছাড়াও খাবারে রান্নার সময় এটি ব্যবহার করা হয় বলে তাপে এর রাসায়নিক উপাদানগুলি পরিবর্তিত হয়ে যায়।
মরিচ ও হলুদ নিয়ে করা বেশিরভাগ গবেষণাই ল্যাবরেটরি পরিবেশে করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধু হলুদ বা মরিচের কারণেই যে দেহে বর্ণিত সব ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো এসেছে তা সেখানে আলাদাভাবে কার্যকারণ সম্পর্ক হিসেবে দেখানো যায়নি। তাই মসলাগুলোর দেহে প্রভাব নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা উচিত নয়। সূত্র: বিবিসি, টিবিএস