রশীদ এনাম :
শিল্প সাহিত্য সৃজনশীলতাকে হৃদয়ে লালন করতে হলে তাঁদেরকে নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা করতে হয়, ভালোবাসতে হয়। হৃদয়ের ক্যানভাসের অলিগলিতে, প্রকৃতি, শিশু ও মা মাটির টানে শিকড়ের টানে যার তুলির আঁচড় সদা বাস্তব জীবনে কথা বলে। একজন পরিপূর্ণ শিল্পীর যে গুণাবলি থাকা উচিত সবকিছু আমি তাঁর মাঝে উপলব্ধি করেছি। এমনই একজন দেশবরেণ্য খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সবিহ্ উল আলমের কথা বলছি।
শিল্পী প্রফেসর সবিহ্ উল আলমের জন্ম ১৯৪০ সালের ৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। তাঁর বাবা ছিলেন তৎকালীন পটিয়ার সাবরেজিস্ট্রার ও পটিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কথাশিল্পী মাহাবুবুল আলম ও মাতা রাহেলা খাতুন। বাবার চাকুরির সুবাদে আলম পরিবার পটিয়ার তালতলা চৌকি গ্রামে ভাড়া বাসায় থাকতেন। আলম পরিবার ৬ বছর পর্যন্ত পটিয়ায় অতিবাহিত করেন। আদি নিবাস হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে। ১১ জন ভাইবোনদের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তাঁর স্ত্রী টইটম্বুরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত সেলিমা সবিহ্। শিল্পী সবিহ্ উল আলম দুই পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তানের জনক। একসময় চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়ির আল আমিন বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার শান্তিনগরে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন।
সদা মিষ্টভাষী ও বিনয়ী শিল্পী সবিহ্ উল আলম ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৫৯ সালে নাইট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে এশিয়া ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তি নিয়ে তিনি লাহোর আর্ট কলেজ থেকে শিল্প ও নকশায় ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান নিয়ে ¯œাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নিজেকে শিল্প ও নকশা পেশায় নিয়োজিত করেন। এসএমই ফাউন্ডেশনের স্পীকার হিসেবেও তিনি নিয়মিত ক্লাস নেন।
শিল্পীর কীর্তি ঃ- ১৯৭১ সালে যে কজন শিল্পী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ছবি আঁকার মাধ্যেমে প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শিল্পী সবিহ্ উল আলম ছিলেন অন্যতম । ছয়জন শিল্পীর ১০৪ ফুট দীর্ঘ আঁকা ছবির নাম ছিল আবহমান বাংলা ও বাঙ্গালী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানবিরোধী সেই ছবিটি দেশের মানুষের মনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে ৭১-র মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও সাহস অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে সেই ছবি। সবিহ্ উল আলম ছিলেন দেশবরেণ্য শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনের সমসাময়িক। বলা যায় অনেকটা গুরু-শিষ্যের মতো। একদা শিল্পী জয়নুল আবেদিন চট্টগ্রামে বেড়াতে গেলে শিল্পী সবিহ্ উল আলমকে পরামর্শ দেন যে, চট্টগ্রামে একটা আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কথা রেখেছিলেন। শিল্পী সবিহ্ উল আলম ১৯৭৬ সালে তাঁর শুভাকাক্সক্ষীদের নিয়ে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর সবিহ্ উল আলম শুধু শিক্ষকতায় থেমে থাকেননি। তিনি ছিলেন একাধারে শিল্পী, গায়ক, মডেল, শিশু ও প্রকৃতিপ্র্রেমী।
১৯৯২ সালে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন শিশু-কিশোর পত্রিকা টইটম্বুর। গত ত্রিশটি বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে। পত্রিকাটি শুধু লেখালেখিতে থেমে নেই। একটি সংগঠনেও রূপ নিয়েছে। টইটম্বুর নিষ্পেষিত পরিবারের পাশে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে গরিব মেধাবী শিশুদের বৃত্তি প্রদানসহ চিকিৎসা সাহায্য ও সহায়তা করে আসছে টইটম্বুর। শিল্পী সবিহ্ উল আলম টইটম্বুরকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন।
চট্টগ্রামে শিশুদের এপটিউট বা প্রবণতা নির্ধারণী স্কুল ফুলকি প্রতিষ্ঠার পেছনেও তাঁর বেশ অবদান রয়েছে। তিনি ফুলকির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ফুলকি স্কুলের পরিকল্পনাকারীও বটে।
শিল্পী সবিহ্ উল আলমকে বিজ্ঞাপন চিত্রের একজন মডেল হিসেবেও দেখি। স্টারশিপ কনডেন্সড মিল্ক, পন্ডস ক্রিম, হোয়াইট প্লাস টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন চিত্রে মডেলিং করেছেন। তিনি বাংলাদেশের রপ্তানি মেলা পরিকল্পনা ও প্রচারের পথিকৃৎ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মাননীয় কচু, রফিক আনোয়ারের সন্ধানে, পিঁপড়ে নেকলেস ও অন্যান্য গল্প, নিমিত্ত মাত্র, হিজ একসিলেন্সি মিস্টার ডিসেনটিরি, নুজমার গপ্পো, লেখা থেকে রেখা, ইসলামিক ক্যালিওগ্রাফি, পিকনিক, কারুকাজের যাদুকর ইত্যাদি। রম্য ও মৌলিক বইগুলো বেশ পাঠক নন্দিত হয়েছে।
ফেনীর বল্লভপুরে হোসনে আরা কাশেম মসজিদ এবং নোয়াখালী বাইতুশ শরিফ মসজিদের নকশা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি.এবং ইবনে সিনা হাসপাতালের লোগো ডিজাইন সবিহ্ উল আলমের হাতে গড়া। সবিহ্ উল আলমকে মাঝে মাঝে গুন গুন করে গাইতে দেখা যায়, অ ব্রিটিশ কোম্পানি, অ ব্রিটিশ কোম্পানি গাট্টিপুস্তা লই ধাইবানি। অতুল প্রসাদের লেখা মা গানটিও তাঁর খুব প্রিয়।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে জাতীয়ভাবে আজও মূল্যায়ন করা হয়নি দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী সবিহ্ উল আলমকে। সবিহ্ উল আলম চট্টগ্রাম সমিতি পদক, চট্টগ্রাম মঞ্চ পদক, চারুশিল্পী পদক, চট্টগ্রাম আর্ট কলেজ ও ফতেয়াবাদ কৃতী সন্তান এবং ৭১ এর শহীদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপ পদকে ভূষিত হন। তিনি রপ্তানিবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারত, সৌদিআরব, আরব আমিরাত, পাকিস্তান, কানাডা, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, লন্ডন, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মালেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, একাত্তরের শিল্পী সবিহ্ উল আলমকে যেন আজীবন সম্মাননা, স্বাধীনতা ও একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।