১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী লাহরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী’র বাস ভবনে সম্মেলিত বিরোধী দলের বিষয় নির্বাচনী সভায় ৬ দফা কর্মসূচী পেশ করার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। বাহ্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত তাঁর এই কর্মসূচি পাকিস্তানি রাজনীতিকে একটি প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে এমন তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিলো যে, অতঃপর ক্রমান্বয়ে ৬ দফাকে ঘিরেই পাকিস্তানি রাজনীতি আবর্তিত হতে থাকে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাঙ্গালি জাতিসত্তাকে জাগিয়ে তোলে এবং আত্মপ্রকাশের আকাঙ্খায় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে অবশেষে পাকিস্তানের পিঞ্জর ছিন্ন করে স্বাধীনতার অনিবার্য গন্তব্যে পৌঁছে যায়। সেজন্যে কত রক্ত, অশ্রু ঝরলো, কত ‘তরুণ অস্তাচলে’ গেল।
ইতিহাসের কি আশ্চর্য পুনরাবর্তন! বঙ্গবন্ধু যেদিন পাকিস্তান ধ্বংসের মারণাস্ত্র ৬ দফা ছুঁড়ে দিলেন, তারই ২৬ বছর পূর্বে, ১৯৪০ সালে আর এক বাঙ্গালি এ কে ফজলুল হক পাকিস্তানের বীজ বপন করেছিলেন। ঘটনাস্থল একই, লাহোর। ফজলুল হকেরটা লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা প্রস্তাবের তেমন কোনো নামকরণ হয়নি। তবে এটা বেশ কৌতুহলোদ্দীপক যে, পাকিস্তানের বিকাশ ও বিনাশের মস্ত্রোচ্চারণের সাক্ষী হয়ে থাকলো লাহোর।
যাই হোক, বঙ্গবন্ধু সম্মিলিত বিরোধী দলের বৈঠকে ৬ দফা দিয়েছিলেন বটে; কিন্তু কোনো বিরোধী দলই তাঁর ৬ দফা সমর্থন বা গ্রহণ করতে সম্মত হলো না। বঙ্গবন্ধু ক্ষুদ্ধ চিত্তে সভা ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন এবং জীবনের ওপর হামলার আশংকায় লাহোরে পাঁচ দিন আত্মগোপন করে থাকলেন। এই সময়ের মধ্যে করাচির ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুণ ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক উকিলের (আবদুল মালেক উকিল তখন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলের নেতা। তাঁর জন্য সরকারী প্রটোকল ছিলো) সহায়তায় পিআইএ’র টিকিট জোগাড় করে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা প্রত্যাবর্তনের জন্যে সকারে লাহোর বিমান বন্দরে উপস্থিত হন। তিনি সেখানে তড়িঘড়ি এক সাংবদিক সম্মেলন ডেকে ৬ দফা কর্মসূচি প্রকাশ করেন এবং বিকেলেই ঢাকা ফিরে আসেন। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রথম প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধু ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপনের খবর। এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জনসভা ডেকে জনগণের সামনে পেশ করবেন ৬ দফা। সেজন্যে তিনি বেছে নিলেন চট্টগ্রামকে। কেননা তাঁর মনে হয়েছিলো ঢাকায় জনসভা করতে গেলে সেটি মোনায়েম খাঁ পুলিশ কিংবা পেটোয়া বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে ভেঙ্গে দেবে। চট্টগ্রামে তাঁর দলের দুই স্তম্ভ ও পরম হিতাকাঙ্খী ও বিশ^স্থ বন্ধু জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম.এ. আজিজ আছেন; তাঁদের যেমন শক্তিশালী সংগঠন আছে, তেমনি ব্যক্তিগত প্রভাবও কম নয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ৬৬ বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে জনসভায় প্রথম জনগণের সামনে ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
৬ দফা নিয়ে আলোচনার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি ৬৬ ঢাকায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকা হয়। ওয়ার্কিং কমিটিতে ৬ দফা সহজে পাস হয়নি। কুমিল্লার আবদুল রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, রাজশাহীর মুজিবর রহমান ও যশোরের মশিউর রহমান ৬ দফার বিরোধিতা করে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। এ সময় জহুর আহমদ চৌধুরী ৬ দফার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন; তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও বলিষ্ঠ বক্তব্যের পর সংখ্যাধিক্য ভোটে ৬ দফা পাস হয়।
লালদিঘি ময়দানে ৬ দফার জনসভা আয়োজনের পেছনে জহুর আহমদ চৌধুরীর ভূমিকা ছিলো সর্বাধিক। জনসভা ডাকাই হয়েছিলো চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের নামে। জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি, ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিলো শুক্রবার; সেদিন সকালে উস্খা ট্রেনযোগে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে বটতলী রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছান। তাঁকে স্টেশনে সংবর্ধনা দেয়া হয়; সংবর্ধনার পর জহুর আহমদ চৌধুরীর দু’জন ঘনিষ্ঠ অনুসারী ও চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের কর্মী ইদরিস আলম ও শাহ বদিউল আলম তাঁকে নিয়ে আসেন জহুর আহমদ চৌধুরীর দপ্তরে স্টেশন রোডের রেস্ট হাউসে। সড়ক ও জনপথ দপ্তরের মালিকানাধীন এই রেস্ট হাউসটি ইজারা নিয়েছিলেন মিরসরাইর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সৈয়দুর রহমান। পরবর্তীকালে তাঁর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আওয়ালী লীগের নেতা ও সংসদ সদস্য (১৯৭০) নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী (১৯৯৬-২০০১-২০১৫) ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
৫৮ সালে আইয়ুব খানের সেনা শাসনামলে জহুর আহমদ চৌধুরী রেস্ট হাউসের ২৩ নং কক্ষটি ভাড়া নেন এবং পরে এই কক্ষে সিটি আওয়ামী লীগের কার্যালয় স্থাপন করে তাঁর রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকান্ড চালান। ২৫ ফেব্রুয়ারী রেস্ট হাউসে বঙ্গবন্ধু থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু রেস্ট হাউস তেমন পরিচ্ছন্ন এবং কক্ষে টেলিফোন সংযোগ না থাকায় বঙ্গবন্ধু সদরঘাট শাহজাহান হোটেলে চলে যান।
২৫ ফেব্রুয়ারী লালদিঘির জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। বক্তৃতা করেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম.এ. আজিজ, আবদুল্লাহ আল হারুণ প্রমূখ। জহুর আহমদ চৌধুরীর নির্দেশে জনসভার প্রস্তাব আগেই লিখ রেখেছিলেন ইদরিস আলম (তিনি তখন একইসঙ্গে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা; সিটি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক)। সভা শেষে জহুর আহমদ চৌধুরী প্রস্তাব পাঠ করেন। জনসভায় পঠিত মোট বিশটি প্রস্তাবের মধ্যে উনিশটি লিখিত ছিলো, একটি জহুর আহমদ চৌধুরী তাৎক্ষণিকভাবে বলেন। দ্বিতীয় প্রস্তাবে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও ৬ দফায় প্রতি পূর্ণ আস্থা ও দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। ইদরিস আলম লেখায় ৬ দফার প্রথম জনসভার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন-
শেখ সাহেব ৬ দফা আন্দোলনের শুরুতে প্রথম চট্টগ্রামে জনসভা অনুষ্ঠানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ২৫ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার লালদিঘি ময়দানে জনসভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ৬ দফার এই প্রথম সভার প্রস্তাবগুলি আমিই লিখি। দুই নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়, এই সভা পূর্ব পাকিস্তানের সিংহহৃদয় বঙ্গশার্দুল সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাইতেছে এবং ৬ দফার ভিত্তিতে দুর্বার গণআন্দোলন গড়িয়া তোলার জন্য জনসাধারণের কাছে আকুল আবেদন জানাইতেছে এবং পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি উক্ত ৬ দফাকে কর্মসূচি হিসাবে গ্রহণ করার জন্য তাহাদেরও মোবারকবাদ জ্ঞাপন করিতেছে। যে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঐতিহাসিক ৬ দফাকে কেন্দ্র করিয়া সমালোচনার মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির প্রয়াস পাইতেছে, তাহাদের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে ৬ দফার সঠিক অর্থ অনুধাবন করিয়া রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিবার জন্য আহবান জানাইতেছে। এই সভা মনে করে, ৬ দফার মধ্যেই অন্তর্নিহিত রহিয়াছে শক্তিশালী পাকিস্তান গড়িয়া তোলার স্বপ্ন।৪৩
এরপর ৬ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য পথসভা, জনসভা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারভিযান চালান জহুর আহমদ চৌধুরী। শহর তো বটেই, গ্রামেও তিনি সিটি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে দূর দূরান্তে গণসংযোগে বেরিয়ে পড়েন এবং ৬ দফা নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। জনসভা করে পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু নোয়াখালী যাওয়ার সময়ে ভয়ে কেউ তাঁর সঙ্গী হতে না চাইলে জহুর আহমদ চৌধুরী তাঁর সঙ্গে যান। তাঁরা সন্দ্বীপ হয়ে নোয়াখালী যান।
৬ দফাকে বাঙালির মুক্তি সনদ আখ্যা দিয়ে সিটি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যা পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। পুস্তিকার রচয়িতা সিটি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ইদরিস আলম ও ভূমিকা লেখেন সাধারণ সম্পাদক এম.এ. মান্নান। চট্টগ্রামে ৬ দফার প্রচারে এই পুস্তিকার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
৮ মে’ ৬৬ নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক শ্রমিক জনসভায় যোগ দেন জহুর আহমদ চৌধুরী। জনসভা শেষ করে রাত্রিযাপনের জন্য ঢাকার সেন্ট্রাল হোটেলে আসেন। সে রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম.এ. আজিজ, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী), এমএস হক এবং আবদুর রহমান সিদ্দিকী গ্রেফতার হন। জহুর আহমদ চৌধুরীকে হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয়। এম.এ. আজিজ গ্রেফতার হন চট্টগ্রামে তাঁর দেওয়ান বাজারের বাসা থেকে। ৬ দফার জন্য প্রথম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সারাদেশ থেকে গ্রেফতার হন ৮ জন। এই গ্রেফতার থেকেই বোঝা যায় চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী ও এমএ আজিজ সরকারের জন্যে কতো দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিলেন।
জেল-জুলুম ও নির্যাতন চালিয়েও ৬ দফার আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষঢ়যন্ত্র মামলা’ নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করে। এই মামলায় চট্টগ্রাম থেকে তিনজনকে আসামি করা হয়। তাঁরা হচ্ছেন ডা. সৈয়দুর রহমান চৌধুরী, মানিক চৌধুরী ও বিধান কৃষ্ণ সেন। ডা. সৈয়দ ও বিধান সেন যথাক্রমে সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক। এই মামলা পরিচালনার জন্য তহবিল গঠনের লক্ষে ‘মুজিব ফান্ড’ নামে একটি কূপন প্রকাশ করা হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রামে এই কূপন এনে বিক্রির ব্যবস্থা করেন এবং আগরতলা মামলা পরিচালনার তহবিল গঠনে অবদান রাখেন।
২০ অক্টোবর ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন শেষে জহুর আহমদ চৌধুরী পল্টন ময়দানে আয়োজিত দলের জনসভায় বক্তৃতা করেন। চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম ঢাকায় জনসভায় ভাষণ দেন।
[‘গণমানুষের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী’ বই থেকে সংকলিত’]