ঢাকা-দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন
সুপ্রভাত ডেস্ক »
২০২৩ সালে শেষ হবে সরকারের অন্যতম মেগা প্রকল্প ঢাকা-দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের কাজ।
সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালে শেষ হবে সরকারের অন্যতম মেগা প্রকল্প ঢাকা-দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের কাজ। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৬৯ শতাংশ। বাকি ৩১ শতাংশ কাজ শেষ হলেই আগামী বছরের জুনে ঢাকা থেকে ট্রেনে কক্সবাজারে যাওয়ার স্বপ্নপূরণ হবে।
অবশ্য এর আগে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, ‘রেলওয়েতে এখন অনেক প্রকল্প চলমান। আগামী বছর (২০২২) ডিসেম্বরের মধ্যেই ঢাকা থেকে কক্সবাজার সরাসরি ট্রেন চলবে।’ ২০২১ সালের ১৮ মার্চ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপন উপলক্ষে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছিলেন মন্ত্রী।
কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় আরও ছয় মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এই লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে কাজ। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ প্রকল্পে কাজ করছেন শ্রমিকরা। একই সঙ্গে আইকনিক স্টেশন, ছোট-বড় সেতু, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিং ও হাইওয়ে ক্রসিংয়ের নির্মাণকাজও এগিয়ে চলছে।
প্রকল্পের কাজে ধীরগতি
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেল মন্ত্রণালয়। কিন্তু গত মার্চ পর্যন্ত দোহাজারী-কক্সবাজার ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৬৯ শতাংশ। করোনা মহামারি ও বিভিন্ন কারণে কাজের অগ্রগতি যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি। এজন্য ডিসেম্বরের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আগামী বছরের জুনে ট্রেন চালুর লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী বছরের জুনে ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের অধীন ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৪২০ কিলোমিটার রেলপথের কাজ চলছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৩২০ ও চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মিশ্র গেজ ডাবল লাইন নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই পথে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেন চলতে পারবে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মিশ্র গেজ রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। এই পথে রেললাইন বসানো শেষ হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দ্রুতগতির ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। রেল যোগাযোগ শুরু হলে সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের। আমুল পরিবর্তন হবে যোগাযোগ, পর্যটন, কৃষি ও মৎস্যসহ লবণ শিল্পের।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের যানজট কমবে
প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের যাত্রীরা। ধারণক্ষমতার বেশি যানবাহন চলাচলসহ নানা কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ চালু হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চাপ কমবে যানবাহনের। সেই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
যা বলছেন প্রকল্প পরিচালক
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে আমরা কাজ করছি। চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ শেষ হচ্ছে না। আরও দুই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছি আমরা। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি। এরপর এই রেলপথে ট্রেনের ট্রায়াল শুরু হবে। কোনও ত্রুটি ধরা পড়লে তা ঠিক করা হবে।’
বাকি ৩১ শতাংশ কাজ শেষ হলেই আগামী বছরের জুনে ঢাকা থেকে ট্রেনে কক্সবাজারে যাওয়ার স্বপ্নপূরণ হবে
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, চকরিয়া, হারবাং এবং রামু এলাকায় ২৫ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৭৫ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের পাশাপাশি চলছে সিগন্যালিং তার টানার কাজ। মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ। ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে মেজর ও মাইনর ব্রিজ এবং কালভার্টগুলোর কাজ।’
কতটুকু এগিয়েছে প্রকল্পের কাজ
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, চকরিয়া থেকে কক্সবাজার অংশে ২০টি সেতুর মধ্যে ১৭টির কাজ শেষ হয়েছে। বসানো হয়েছে সাড়ে ১২ কিলোমিটার রেললাইন। দোহাজারী-চকরিয়া অংশে ১৯টি সেতুর মধ্যে সাঙ্গু নদীর ওপর একটি, মাতামুহুরী নদীর ওপর দুটি এবং বাঁকখালী নদীর ওপর একটি বড় রেলসেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর নির্মাণকাজ চলমান আছে। কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনসহ সব মিলিয়ে নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে রেলপথের জন্য। এর মধ্যে ডুলাহাজারা রেল স্টেশনের কাজ শেষের দিকে। দোহাজারী, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ঈদগাঁও এবং কক্সবাজার রেল স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। শুরু হয়েছে সাতকানিয়া এবং রামুতে রেল স্টেশন নির্মাণের কাজও। রেলপথ বসানোর প্রয়োজনীয় মাটির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সবমিলে ২৫ কিলোমিটার পথে রেললাইন বসেছে।
দুই দফায় বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়
২০১০ সালের ৬ জুলাই ‘চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমানা পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। প্রকল্পের অধীনে দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কথা ছিল।
২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন
২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেললাইন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। প্রায় আট বছর পর ২০১৮ সালে ডুয়েল গেজ ও সিঙ্গেল ট্র্যাকের রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে মিয়ানমার সরকারের সম্মতি না থাকায় আপাতত রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ হচ্ছে না। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। পরে ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
দ্বিতীয় দফায় সময় বাড়ানোর প্রস্তাব
২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালে। ওই সময় প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে। তবে জমি অধিগ্রহণ, বনাঞ্চল নিরাপদ রাখার জটিলতাসহ নানাভাবে প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হয়। এখন আরও দুই বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এটি এখনও অনুমোদন হয়নি।
কক্সবাজার সদর থেকে সাত কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন। আইকনিক স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। আইকনিক রেল স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান আছে। নির্মাণাধীন আইকনিক ভবন ঘেঁষে হচ্ছে রেলওয়ের প্ল্যাটফর্ম। এর পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের কাজ শেষ পর্যায়ে। স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যানটিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দিনে ৪৬ হাজার মানুষ এই স্টেশন দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারবেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এখন সিঙ্গেল লাইন স্থাপন করা হলেও ভবিষ্যতে ডুয়েল গেজ লাইন স্থাপনের জায়গা অধিগ্রহণ করা আছে। চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো সময় এটি ডুয়েল গেজ লাইন করা হবে। তখন সিঙ্গেল লাইন দিয়েও ঢাকা থেকে কক্সবাজার ট্রেনে আট ঘণ্টায় যাতায়াত করা সম্ভব হবে।
আমূল পরিবর্তন ঘটবে যোগাযোগ, পর্যটন ও কৃষি শিল্পে
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. এখলাছ উদ্দিন বলেন, ‘ঢাকা-কক্সাবাজার ট্রেন চালু হলে অবশ্যই এই অঞ্চলের কৃষিতেও দারুণ পরিবর্তন ঘটবে। কম টাকায় কৃষিপণ্য, মাছ ও লবণ পরিবহনের ক্ষেত্রে সহজ হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন হবে।’
তিনি বলেন, ‘এই রেললাইন হলে কৃষি তথা এলাকার কিছু ক্ষতিও হবে। যদি না সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হয়। রেললাইনের পাশে পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেও পানি জমবে। এ কারণে ক্ষেত-ফসল পানিতে ডুবে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হতে পারে। ব্রিজ-কালভার্ট এবং পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকলে এ অবস্থার সৃষ্টি হবে। এদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন।’
দোহাজারী হাইওয়ে থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পর্যটন মৌসুমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। রেলপথের কাজ সম্পন্ন হলে সড়কে যানবাহনের চাপ অনেক কমে যাবে। দুর্ঘটনাও কমবে।’