নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, সাহিত্যিক মরহুম ড. রশীদ আল ফারুকীর সন্তান চবি ২১ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ব্যাংকার আহম্মেদ সাইফুদ্দিন খালেদ খসরু সোমবার (১১ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টা–৫০ মিনিটে নগরীর পার্ক ভিউ হসপিটালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে…রাজেউন)।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়েসহ অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি নানা সময়ে বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছাব্বিশতম ব্যাচের শিক্ষার্থী সমাজতত্ত্ব বিভাগের শাকিলা নাসরিনের স্বামী। মরহুম খসরু সমাজ সমীক্ষা সংঘের অন্যতম পরিচালক, খেলাঘর মহানগর কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। বিশিষ্ট কলামিস্ট ও ব্যাংকার মরহুম মোহাম্মদ ইদ্রিস ছিলেন তাঁর শ্বশুর। ব্যাংকার খসরুর ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে চবি ২৬ তম ব্যাচ, জেলা সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়নের পক্ষ থেকে।
৫৮ না পেরোতে আহমেদ সাইফুদ্দিন খালেদ খসরু চিরবিদায় নিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার শৈশব কৈশোর ও ছাত্র জীবন কেটেছে। প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বল, বন্ধু বৎসল, সহাস্য ও রসিকতাময় মানুষ ছিলেন তিনি। পিতা ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক, সাহিত্যিক। একই সাথে নানামুখী সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্য সংগঠনের সাথে যুক্ত। বাসা ভর্তি নানানরকম বই পত্র। বিভিন্ন মননশীল, ঋদ্ধ, গুণী ব্যক্তিদের নিত্য সংস্পর্শে ছিল এ পরিবার। স্বাভাবিক ভাবেই একটি সুরুচি সম্পন্ন সাংস্কৃতিক আবহে গড়ে ওঠেছে তার প্রাথমিক বেড়ে ওঠার দিনগুলো। ছাত্র জীবনে রোভার স্কাউট এর সাথে যুক্ত ছিল খসরু। অনেকটাই অপরিহার্য গন্তব্যে সে যুক্ত হয়ে যায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এর সাথে। বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্ব পালন শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন এর সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবার আগেই তার বাবা ড. রশীদ আাল ফারুকী অকাল মৃত্যু বরণ করেন। দু ভাই ও এক বোন আর মা নিয়ে ছিল তাদের পরিবার। ছাত্র জীবন উত্তর কালে তার মা, মুরাদপুরে পৈতৃক জায়গায় একটি ফ্লাট নির্মাণ করেন। ৯০ উত্তর দশকের সময়টা খসরু সে বাড়িতেই থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবন শেষে খসরু প্রথমে চাকরি নেন ব্র্যাক এনজিও তে। পরবর্তীতে আজিম গ্রুপে। বেশ কয়েক বছর পর ব্যাংকার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন ব্র্যাক ব্যাংকে। জীবনের শেষ কয়টা বছর ছিলেন ইউসিবিএল ব্যাংকে।
রাজনীতিতে তখন দিশাহীনতার কাল। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ছিন্ন ভিন্ন। সিপিবি বিলোপবাদের কবল থেকে বেরিয়ে নতুন করে সংগঠিত হবার চেষ্টায় রত। এমনি প্রেক্ষিতে শ’খানেক যুবক নিয়ে আমরা চট্টগ্রামে সম্পন্ন করি যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা সম্মেলন। তখন
১৯৯৫ সালের শেষ দিক। যদিও নিয়মিত কোন কাজের মধ্যে থাকা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, খসরু সহ আমাদের শহরের একদল যুবক এর তখন নিত্য ওঠা বসা। ভরপুর আড্ডা। তখন হাসান ইমাম চৌধুরীর বাড়ির ছাদে চিলেকোঠায় মোহাম্মদ আতিক, ডাঃ মিলাদ, খসরু, কখনো কখনো রাজশাহীর সাবেক ছাত্র নেতা হাবিবুজ্জামান চুনী সহ মাঝে মধ্যে অন্য দুয়েকজনের অংশগ্রহণে চলত দিনমান আড্ডা। ১৯৯৫-৯৬ সনে ছিল আওয়ামী লীগের ডাকে নিয়মিত হরতাল। তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে। সবার অফিস কার্যত: বন্ধ থাকত। আমাদের আড্ডা আরো প্রবল হয়। ঢাকা থেকে তখন ক্বাফী রতন তার ব্যাংকের কাজে বেশ ক’দিন চট্টগ্রামে এসেছিলেন। দিনভর গল্প, সন্ধ্যায় আমরা দারুল কাবাব এর মাঠেও কিছুদিন বসতাম। সেই আড্ডার ৩ বন্ধু আজ নেই। প্রথমে চুনী, তারপর হাসান ইমাম, গতকাল খসরু। চিরপ্রস্থান নিলেন।
ক্রমশঃ আমাদের বন্ধুদের পেশাগত ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। ব্যক্তি থেকে ঘোর সংসারী হয়ে উঠতে শুরু করি। তারপরও একসময় আমরা সন্ধ্যায় হাজারী গলিতে সিপিবি অফিসের পেছনে ব্যাডমিন্টন কোর্ট করি। দিনজুড়ে যার যার কাজ শেষে দেখা হয় ব্যাডমিন্টন কোর্টে।
১৯৯৯ সনে চট্টগ্রামে আমরা বিশাল পরিসরে যুব উৎসব করি। দেশ বরেণ্য নানান ব্যক্তিত্ব আর বৈচিত্র্যময় ছিল সে উৎসব। অধিকাংশ অতিথির প্রটোকল এর দায়িত্ব ছিল খসরুর।
২০০১ সনে যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা আয়োজন করে দুই দিনব্যাপী জমজমাট লোক সংস্কৃতি উৎসব। শিল্পকলা একাডেমির মাঠে। বিশাল এ আয়োজনে খসরু ছিল নিত্য অংশগ্রহণকারী।
২০০২ সনে ছাত্র ইউনিয়ন এর সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব এর অতিথিদের জন্য ট্রেনের টিকেট কেটে ফেরার সময় ছিনতাইকারীদের হাতে ছুরিকাহত হয় খসরু। ফলে আয়োজন এর সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থেকেও মুল অনুষ্টানে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি তিনি।
২০০৪ সনে আমরা ” বন্ধ শিল্প কারখানা খুলে দাও , কর্মসংস্থান গড়ে তোল” শিরোনামে সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রাম শহর অবধি ৩২ কি.মি. পদযাত্রা করি যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার আয়োজনে।
খসরু যার ডাক নাম তিনি অফিসে পরিচিত ছিলেন “খালেদ ” নামে। কারো কাছে খালেদ, কারো কাছে “খালেদ ভাই”, কারো কাছে ” খালেদ স্যার “। আমাদের বন্ধু ডাঃ মিলাদ ভাই ডাকতেন খালেদ সাহেব। আমিও কখন কিভাবে যেন ডাকতে শুরু করি ” খালেদ সাহেব “। ২০০৬ সনের দিকে আমরা গড়ে তুলি সমাজ সমীক্ষা সংঘ। অজস্র ভাবনা চিন্তা, মত বিনিময়, ছোট ঘরোয়া পরিসরে খসরু ভাই এর সাথে আমার চিন্তার সংশ্লেষ ঘটে। একদল প্রাণোচ্ছল তরুণ, যুবা ও অপেক্ষাকৃত সিনিয়র এর নিরবচ্ছিন্ন অংশগ্রহণে আমাদের এ যাত্রা আলোর মুখ দেখে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব গোলাম মুস্তফাকে আমাদের কাজের সাথে যুক্ত করেন। কবি আবুল মোমেন শ্লোগান ঠিক করে দেন ” অসীম জ্ঞান, অবাধ মনন “। দিন ও রাতের ফারাক ঘুচিয়ে, অজস্র সভা, কাজ, চিন্তা, মনন এর সবটুকু সাধ্য নিয়ে আমরা আয়োজন করি ডঃ রশীদ আল ফারুকী স্মারক বক্তৃতা, মাস্টারদা সূর্যসেন স্মারক বক্তৃতা, তাজউদ্দীন আহমেদ স্মারক বক্তৃতা, কর্ণেল তাহের স্মারক বক্তৃতা, দর্শনীর বিনিময়ে বিজ্ঞান বক্তৃতা, মহান অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকী স্মারক বক্তৃতা, কার্ল মার্ক্স এর দ্নিশততম জন্ম বার্ষিকী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর ৭৫ তম জন্ম বার্ষিকী, অসংখ্য পাঠচক্র, ঋতু বন্দনা, একে একে সাতটি লোক সংস্কৃতি উৎসব। এই সকল ব্যাপক কাজের মধ্যে সাইফুদ্দীন খালেদ খসরু ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পোশাক পরিচ্ছদে খসরু ছিল সবসময়ই পরিপাটি। যে কোন আড্ডায় সহজেই মধ্যমণি হয়ে ওঠার সহজাত গুণাবলী ছিল তার। বন্ধু মহলে, কর্মস্থলে, সাংগঠনিক ও রাজনীতির যে কোন কাজেই শুধু নয়, বরং সমাজের স্বাভাবিক ও দৈনন্দিনতায় সে ছিল অবাধ, সহজ ও সাব্যস্তের মানুষ।
অনেক সিরিয়াস আলোচনা ধর্মী বইয়ের পাশে খসরুর প্রিয় ছিল মাসুদ রানা সিরিজের বই। এডভেঞ্চার মুভি ছিল তার পছন্দের। ভ্রমণ ছিল তার ভীষণ প্যাশন। আর ডি বর্মণ, হেমন্তের গান, রবীন্দ্র সংগীত ছিল তার প্রিয়। চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, ঢাকা, সিলেট সহ অসংখ্য ভ্রমণে তার সাথী ছিলাম।
আড্ডায় অনবদ্য, তুখোড় আমুদে, পরিশীলিত যুক্তি ও তর্ক, সমাজ ও রাজনৈতিক বিষয়াবলীতে দারুণ ভাবিত সদা স্মার্ট তরুণ খসরুর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিল জোসেফ স্ট্যালিন, চে গেভারা, জওহরলাল নেহেরু, শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ ফরহাদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সহ আরো অনেকে। ডঃ অনুপম সেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ডঃ মাহবুবুল হক, কবি আবুল মোমেন সহ বরেণ্য অনেকের প্রিয়ভাজন ও স্নেহধন্য ছিলেন খসরু। মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, দু সন্তান রেখে গেছেন খসরু। তাদের বেদনা আজ অবর্ণনীয়।
খসরু বিশ্বাস করতেন মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজে। যুক্তি ও বুদ্ধির মুক্তিতে খসরুর আশাবাদ ছিল সবসময়। তার পরিচিত জনদের কাছে একই সাথে আস্থা, ভালোবাসা ও সাহচর্যের জন্য নির্ভরতার মানুষ ছিলেন খসরু। দেয়ার ছিল তার আরো অনেকটা। তার পরিবার এর সদস্যদের পাশাপাশি অনেকেই আজ স্বজন হারানোর বেদনায় মূহ্যমান। খসরুর জন্য ভালোবাসা।