হুমাইরা তাজরিন »
সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ। ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর মোড়ের অরক্ষিত নালায় পা পিছলে পড়ে নিখোঁজ হন। ঘটনার দিন ভারি বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে রাস্তা এবং অরক্ষিত নালা একাকার হয়ে যাওয়াতে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও আজো খোঁজ মেলেনি সালেহ আহমেদের। এখনো অরক্ষিত সেই দুর্ঘটনাস্থল।
বাবা হারানোর দিনটিকে স্মরণ করে গতকাল মুরাদপুর মোড়ের ঘটনাস্থলে এসেছিলেন ছেলে সাদেকুল্লাহ মহিম। এসময়ে বার বার আহাজারি ভেসে ওঠে তার কন্ঠে, ‘ অরক্ষিত নালায় পড়ে আমার বাবা হারিয়ে গেলো, অথচ দায় নিলোনা কেউ!’
বাবার ভালোবাসার কথা উঠে আসে মহিমের কথায়। দীর্ঘ ২ মাস খোঁজাখুঁজির পরও বাবাকে ফিরে পায়নি।
সবজি বিক্রতা সালেহ আহমেদ ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কথা ভেবে তাদেরকে পরিবারের কোনো কাজ করতে দেননি।
মহিমের কাছ থেকে জানা যায়, তার মাসহ ভাইবোনেদের দিন কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়। নিকট আত্মীয়দের দয়া দাক্ষিণ্যে কোনোভাবে বেঁচে থাকলেও প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে দারিদ্র্যের কষাঘাত। পরিবারে উর্পাজনক্ষম আর কেউ না থাকায় মহিম এবং তার বোন জান্নাতুল মাওয়া মিতুর পড়ালেখা এখন বন্ধ হওয়ার পথে।
মিতু বর্তমানে স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজে মানবিক বিভাগে পড়াশোনা করছে। মহিম বিজ্ঞান বিভাগ মাধ্যমিক পাশ করে পটিয়া কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তির জন্যে আবেদন করেছেন।
মহিমের বাবার মৃত্যুর পর সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী মানবিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় এইচএসসি পরীক্ষার্থী মহিমকে কর্পোরেশনের অধীনে ফিলিং স্টেশনে টিকিট কাউন্টারে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু চাকরি হওয়ার পর জানতে পারেন কাউন্টারে নয়, টানা ১২ ঘণ্টা গ্যাস ফিলিংয়ের কাজ করবেন তিনি। পটিয়া থেকে দীর্ঘ সময় জার্নি করে ১২ ঘণ্টার এই ডিউটি করে লেখাপড়া চালানো দুঃসাধ্য হওয়ায় মেয়রকে অনুরোধ করেন যাতে পড়ালেখা চালানো যায়। এজন্য পিয়নের চাকরি পেতে আবেদন জানান। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় ফিলিং স্টেশনের চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
বর্তমানে উপার্জনের কোনো উৎস না থাকায় এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সালেহ আহমেদের পরিবার প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
এদিকে, সালেহ আহমেদের নিখোঁজের ২ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ দাবি করে উচ্চ আদালতে করা রিটের প্রেক্ষিতে জারি করা রুলের জবাব দেয়নি অভিযুক্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের প্রেক্ষিতে সালেহ আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি কর্পোরেশনের গাফিলতির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ২ অক্টোবর ২০২১ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. মিজানুর রহমানকে (উন্নয়ন) আহ্বায়ক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
সেই কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) তাদের বক্তব্যে প্রকল্পস্থানে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলো বলে দাবি করে। সিডিএ সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি/ সাইনবোর্ড, টিনের নিরাপত্তামূলক বেষ্টনী/ রঙিন ফিতা ,নিরাপত্তা কর্মী, রাত্রিকালীন লাইটের ব্যবস্থা এবং পথচারী ও যানবাহন চলাচলে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে।
কমিটির প্রতিবেদনের মতামতে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কেউই এ ঘটনায় দায় স্বীকার করেননি। প্রত্যক্ষদর্শী দোকানদারদের বক্তব্য অনুযায়ী ঘটনাস্থলে পূর্বে খালের উপর স্ল্যাব ছিলো। বছর খানেক আগে (২১ সালের ২৫ আগস্টের আগে) খাল সংস্কারের জন্য স্ল্যাবটি ভেঙে ফেলা হয়। তখন থেকেই খালটি উন্মুক্ত ছিলো। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে চট্টগ্রাম মহানগরীর ৩৬টি খালে প্রতিরোধ দেয়াল ও খনন কাজ চলমান রয়েছে। দুর্ঘটনার স্থানটি উক্ত প্রকল্পের আওতাভুক্ত হওয়ায় খালের পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য বছর খানেক পূর্বে স্ল্যাবটি ভেঙে ফেলা হয়। ঘটনার দিন পর্যন্ত ঐ স্থানে স্লাব তৈরি না করায়, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট ঘটনার দায় দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকের উপর বর্তায়। তবে নাগরিকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। উক্ত দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যথাযথভাবে পালন করেছে বলে প্রতীয়মান হয় না।’
তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত দুটি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির বিষয়টি উঠে আসলে সালেহ আহমেদের ছেলে সাদেকুল্লাহ মহিম ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করেন। এই রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরী ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিবাদিদের ক্ষতিপূরণ দিতে প্রয়োজনীয় আদেশ চেয়ে রুল জারি করেন। রুল জারির ৪ সপ্তাহের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কেন ৬০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবেনা , তা ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৪ সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেলেও রুলের কোনো জবাব দিতে পারেনি চসিক এবং সিডিএ।
সাদেকুল্লা মহিম বলেন, ‘সিডিএ এবং সিটি কর্পোরেশনের গাফিলতির কারণে আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমার বাবাকে হারিয়েছি। যার কারণে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছি। এ অবস্থায় আদালত নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ (৬০ লাখ টাকা) প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি।’