মো. মামুন অর রশিদ চৌধুরী »
মাতৃভাষা প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ধারণা, অনুভূতি এবং আবেগ প্রকাশ করার একটি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অধিকার। “মা” এবং “মাতৃভাষা” শব্দগুলি একে অপরের জন্য অপরিহার্ষ। দুটি শব্দের মধ্যে রয়েছে একটি নিগূঢ় সম্পর্ক যা একটি বৃক্ষের একই শাখায় প্রস্ফুটিত দুটি পুষ্পের মতো। আমাদের বাকস্বাধীনতা পেতে সংগ্রাম করতে হয়েছে, জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। আমাদের দেশের সাহসী সন্তানেরা ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
বাঙালি হিসেবে আমাদের মায়ের ভাষা বা মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষায় কথা বলা মানুষের জন্মগত অধিকার । এই অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। কোন মানুষের মাতৃভাষার বিরুদ্ধে আক্রমণ বা কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে চরম নিষ্ঠুরতা, একজন মায়ের মর্যাদার অবমাননা। যে কোন স্বাভাবিক মানুষের কাছে এধরনের জঘন্য কাজ কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না।
১৯৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যাওয়ার পরে আমরা ১৯০ বছর ধরে ব্রিটিশদের উপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিলাম। তারপরে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা ভূখ- নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ “পাকিস্তান” নামে পরিচিতি লাভ করে । তবে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সাথে সৎ মায়ের নিষ্ঠুর মনোভাব নিয়ে আচরণ শুরু করে । তারা এতটাই নিষ্ঠুর এবং জঘন্য ছিল যে, এদেশের সংস্কৃতি এবং রীতিনীতির উপরে নোংরা হস্তক্ষেপ করতে কোন দ্বিধা বোধ করেনি।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তান সরকার “উর্দু” কে তাদের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে । তবে এদেশের মানুষ উর্দুকে মাতৃভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে । ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল আবারো উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করেন। ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘোষণার প্রতিবাদ করে। ১৯৫২ সালে ২০ শে ফেব্রুয়ারি পুরো ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। পরের দিন অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আমতলায় সমবেত হতে শুরু করে এবং ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে সমাবেশ ও মিছিল শুরু করে। সমাবেশে পুলিশ নির্মমভাবে গুলি চালায় এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকে শহীদ হন।
২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মানুষের গৌরব অর্জনের দিন। এটি আগে “শহীদ দিবস” হিসাবে পালন করা হত। এটি ছিল বাঙালির ভাষা আন্দোলনের বেদনাদায়ক স্মরণীয় দিন। বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ যার মানুষ মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন করে জীবন উৎসর্গ করেছে। এ দিনটি আমাদের সকল ধরনের নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, প্রতিবাদ করতে এবং লড়াই করতে শিখিয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর যে চেতনা তা এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের অন্তরে রোপিত হয়েছে।
১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের একটি সংস্থা ইউনেস্কো আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং শহীদদের আত্মত্যাগের বিষয়টি স্বীকৃতি দেয়। তারা দিনটিকে আন্তর্জাতিক ভাবে পালন করার ঘোষণা দেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি বিশ্ব জুড়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারা দিবসটি পালনের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের জাতীয় গৌরব এবং আমাদের ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা হয়েছে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে আমাদের ভাষা দিবসটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে।
আমাদের ভাষা দিবসের স্বীকৃতি এবং সার্বজনীনভাবে দিবসটি পালনের ঘোষণাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ । ইউনেস্কোর গ্রহণযোগ্যতা কেবল আমাদের ভাষা আন্দোলনের উপলব্ধি নয়। এটি স্বীকৃতি দেয় যে, প্রত্যেক জাতির তাদের নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার সংকল্প জন্মগত অধিকার। ইউনেস্কো আরও ঘোষণা করেছিল যে, এই স্বীকৃতি বিশ্বের সমস্ত ভাষা সংরক্ষণে সহায়তা করবে। সংস্কৃতিগত পরিচয় এবং পার্থক্য বজায় রাখতে ভাষার বিভিন্নতা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য শুধুমাত্র বর্ণনায় বা শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। মাতৃভাষা দিবস আমাদের ইতিহাস এবং আমাদের অর্জনের গৌরবময় স্বীকৃতি। এটি ভাষাগত পরিচয় এবং বৈচিত্রের গুরুত্ব তুলে ধরে। দিনটি জাতির জীবনে বিশাল এক পরিবর্তন এনেছে। এটি ছিলো আসলে অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায় বিচারের বিজয়, বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবতার বিজয়।
তবে ২১ শে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব এবং এর ব্যাপ্তি অন্য কোথাও বিরাজমান। ১৯৫২ সালের এই দিনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছিলো যে, বিশ্বে আমাদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য, আমাদের অধিকার অর্জনের জন্য আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে। এ দিন আমাদেরকে কোনও নিপীড়নের কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা দেয়। এ দিন জাতির স্বার্থে আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসকে ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মা, মাতৃভূমি বা জন্মস্থান এবং মাতৃভাষা-মানবজীবনে সবচেয়ে গভীর আবেগের বন্ধন। মাতৃভাষা অবলম্বন করে একটি জাতি লালিত ও বিকশিত হয়। জাতীয়তাবাদ, কল্পনাশক্তি, আত্মার আবেগ, তৃষ্ণা, হৃদয়ের ভালবাসা প্রকাশিত হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। তাই মাতৃভাষা মায়ের মতো এবং যারা এ মাতৃভাষাকে ছিনিয়ে নিতে চায় তাদের রক্তের বিনিময়ে হলেও প্রতিহত করতে হবে। আমাদের সংগ্রাম, আমাদের সাহসী মানুষ, আমাদের গৌরব কেবল আমাদের নিজেদের ইতিহাসই নয়, আমরা বিশ্বব্যাপী “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে উদযাপন করি। আমরা আমাদের ভাষাশহীদদের জন্য সত্যই গর্বিত। আমরা তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের ফলে মাতৃভাষায় কথা বলি। এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। এগুলি আমাদের অন্তরের অন্তস্থলে সর্বদা বিরাজ করবে এবং মাতৃভাষার জন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করার স্মৃতি প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেবে। এই দিনটির বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা আমাদের গর্বিত করেছে এবং বিশ্বব্যাপী তাদের ত্যাগকেও মহিমান্বিত করেছে।
প্রতিটি জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। এই দিনে সচেতন মানুষ সকল প্রকার অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে জাতির ঐক্যের প্রতিশ্রুতিতে পুনঃপ্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। সুতরাং এই দিনটি বিশ্বের ইতিহাসে অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে। এই দিনটিতে আমাদের মূল দায়িত্ব হবে যে কোনও মূল্যে আমাদের ভাষাকে বিকশিত করা। আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসা কেবল তখনই প্রমাণিত হবে যখন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার করতে সক্ষম হবো। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসী থাবায় আবার যেন কেউ রক্তে অর্জিত বাংলা ভাষাকে ছিনিয়ে নিতে না পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন এবং সজাগ থাকতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক