বাসস :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে কার্যত কারবালার বিয়োগান্তক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং জিয়াউর রহমান ছিলেন ওই হত্যাকান্ডের নেপথ্য খলনায়ক।
জাতীয় শোক দিবস ও আশুরা উপলক্ষে আজ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞ ও কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্যে বিস্ময়কর মিল রয়েছে।’
তিনি বলেন, নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র ও মুসলমনদের ইমাম হযরত হোসেন (রা.)-কে কারবালায় হত্যা করা হয় আর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আরো বলেন, কারবালার ঘটনায় নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের ওই ঘটনায় নারী-শিশুদেরও রেহাই দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে শিশু ও নারীদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়াও, ওই রাতে মিন্টু রোডে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী ও আত্মীয়দেরও হত্যা করা হয়।
আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই আলোচনা সভায় অংশ নেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সচিবগণও তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগ যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। আলোচনা সভার পর এক বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং ঢাকা দুই সিটি ইউনিটের নেতা-কর্মীরা রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলীয় কার্যালয় থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদৎ বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় অংশ নেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ইমাম হোসেন (রা.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-কে ৬৮০ সালের ১০ মুহররম কারবালার ময়দানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কারণ তিনি ন্যায়ের পথে ছিলেন।’
আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি’র সভাপতি বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির আলোচনা সভাটির সঞ্চালনা করেন।
সভার শুরুতে বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্টের অন্যান্য শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে হত্যাকারীরা তাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য এবং গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে এই হত্যাযজ্ঞে জিয়ার সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্য ও তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাকও এই ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পূর্ণ জড়িত ছিলেন। ইতিহাসের পাতায় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তার নাম লেখা থাকবে। এই জঘন্য হত্যাকান্ডের পরপরই মোস্তাক নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া খন্দকার মোস্তাকের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি জেনারেল শফিউল্লাহ্’কে সরিয়ে জিয়াকে সেনা প্রধান করেন।
তিনি বলেন, ‘খন্দকার মোস্তাক বঙ্গভবনে থাকাকালে জিয়া ঘনঘন সেখানে যাতায়াত করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সাথে বৈঠক করতেন। এই সব ঘটনা মানুষের সামনে এখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে জিয়ার সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনী ফারুক, রশিদ, নূর, হুদা, শাহরিয়ার, মোসলেউদ্দিন, রাশেদ, পাশা, খায়রুজ্জামান এবং এরকম আরো কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ‘আমি জানি না জাতির পিতাকে হত্যা করে তারা (হত্যাকারীরা) কি জঘন্য আনন্দ পেয়েছে… এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমে তারা কি পেয়েছে এবং কার কাছ থেকে তারা এত বড় সাহস পেয়েছে?
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা আরও প্রশ্ন করেন, জাতির পিতার অপরাধ কি ছিল?
তিনি বলেন, এটাই কি তার অপরাধ ছিল যে, তিনি একটি জাতির স্বাধীনতা নিয়ে এসেছিলেন এবং আত্মপরিচয় লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন। এটাই কি তার অপরাধ ছিল, তিনি জনগণকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং একটি উন্নত জীবন উপহার দিতে চেয়েছিলেন?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান নামে রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপক অবদান রয়েছে। তিনি বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) সংগ্রাম করেছেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেলো যে, বাঙালিরা শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছে এবং তিনি বাঙালিদের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম শুরু করেন এবং এই সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৮ সালে যখন আমাদের মাতৃভাষা ছিনিয়ে নিতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বারবার জেলে গেছেন। কেন তিনি তার জীবনে এতো আত্মত্যাগ করেছেন? এই আত্মত্যাগ ছিল শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণের জন্য।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী সংগ্রাম করেছেন এবং তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেন, তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, কিন্তু তারা মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি এবং তারা একটি লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে গেছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্য অর্জন করতে একটি পরিকল্পিত উপায়ে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছেন এবং বারবার বাঙালিদের দাবি উত্থাপন করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, কিন্তু তিনি নিজের দিকে তাকাননি বা নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপোস করেননি। কারণ তিনি জনগণ ও তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছেন এবং এই দাবি স্বাধীনতাপ্রেমী জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, ছয় দফা দাবিতে তাদের স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা সেই মূহুর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন যখন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাঙালিদের উপর হামলা শুরু করেছিল।
তিনি আরো বলেন, ‘এর আগে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতিকে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার উপায় সম্পর্কে নির্দেশনা দেন এবং বাঙ্গালী জাতি এসব নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল।
শেখ হাসিনা স্মরণ করেন, জাতির পিতা যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা চালায়। তিনি বলেন, পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে এবং তাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে কারাগারে আটক রাখা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানে কারাগারে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু যে বেদনা ও কষ্ট পেয়েছিলেন সেবিষয়ে তিনি সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট ছাড়া আর কারো সঙ্গে কথা বলেননি।
তিনি (বঙ্গবন্ধু) একটি সাক্ষাৎকারে ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে কিছু কথা বলেছিলেন এবং আমরা তার কাছ থেকে (ফ্রস্ট) জেনেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর পিঠে এবং মাথা থেকে পা পর্যন্ত রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।