হৃদয় হত্যাকাণ্ড
আলামত নষ্টের জন্য খুনের পর মাংস-হাড় কেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়
নিজস্ব প্রতিবেদক
পুরোনো ঝগড়ার রেশ ধরে রাউজানের শিবলী সাদিক হৃদয় (১৯) নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীকে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, এরপর জবাই করে হত্যার ঘটনায় মূল হত্যাকারী উচিং থোয়াই মারমাসহ তার আরেক সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
গতকাল রোববার সকালে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুব আলম।
এ ঘটনায় ইতিপূর্বে আরও ৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ নিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অন্তত ৯-১০ জন জড়িত বলে জানায় র্যাব। অন্যান্য আসামিরা এখনও পলাতক।
শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পতেঙ্গা থানার সমুদ্র সৈকত এলাকায় অভিযান চালিয়ে মূল হত্যাকারী উচিংথোয়াই মারমাকে (২৩) গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিকেল ৫টার দিকে কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যার ঘটনার আরেক সহযোগী ক্যাসাই অং চৌধুরীকে (৩৬) গ্রেফতার করা হয়।
জবানবন্দিতে যা উঠে আসে
শিবলী সাদিক হৃদয় রাউজানের কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি স্থানীয় একটি মুরগির খামার ব্যবস্থাপনার কাজ করতেন। একই খামারে কাজ করা কয়েকজন সহকর্মীদের সঙ্গে হৃদয়ের কথা কাটাকাটি হয়। পরে এ নিয়ে তাদের সঙ্গে কয়েকদফা বাগবিতণ্ডা হয়। ঘটনার পর এসব বিষয়ে খামারের মালিক তা মীমাংসা করে দেন।
এরপর সেই পুরোনো ক্ষোভের জেরে ঐ খামারের কর্মচারী উমংচিং মারমা ও অংথুইমং মারমা কৌশল খুঁজতে থাকেন হৃদয়কে মারার। তাদের এ পরিকল্পনায় অংশ নেয় আরও কয়েকজন।
২৮ আগস্ট রাত ১০টায় কদলপুর এলাকায় মাজার গেটে এসে উমংচিং মারমা ফোন করে হৃদয়কে রাস্তায় আসতে বলে। তার কথা মতো হৃদয় রাস্তায় আসলে উমংচিং মারমাসহ অন্যরা তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে আগে থেকে ঠিক করে রাখা রাউজানের একটি উঁচু পাহাড়ের সেগুনবাগান এলাকায় নিয়ে যায়। পরদিন ২৯ আগস্ট রাতে হৃদয়কে জবাই করে হত্যা করা হয়। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী উমংচিং মারমা হৃদয়কে হত্যার দায়িত্ব দেয় উচিংথোয়াই মারমার ওপর। সে নিজ হাতে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করে হৃদয়ের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং ক্যাসাই অং চৌধুরীসহ অন্য আসামিরা হৃদয়ের হাত-পা ও মুখ চেপে ধরে জবাই করতে সহযোগিতা করেন। জবাইয়ের পর হৃদয়ের লাশ প্রথমে পাহাড়ের চূড়ায় কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রেখে দেয়া হয়।
পরে হত্যাকাণ্ডের আলামত ধ্বংস করার জন্য হৃদয়ের লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। মূলত লাশ যাতে শনাক্ত না করতে পারে, সে জন্য হত্যার পর শরীর থেকে মাংস কেটে আলাদা করে খুনিরা। হাড়গোড়-মাংস গহীন পাহাড়ের জঙ্গলে ছিটিয়ে রেখে চলে আসে হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা উচিংথোয়াই মারমাসহ অন্য খুনিরা।
এরপর ৩০ আগস্ট উমংচিং মারমা তার বন্ধু উচিংথোয়াই মারমার মোবাইলে সিমকার্ড ঢুকিয়ে মুক্তিপণের টাকা চেয়ে হৃদয়ের বাবাকে ফোন দেয়। এরপর ১ সেপ্টেম্বর অপহরণকারীর কথা অনুসারে বান্দরবানে গিয়ে উচিংথোয়াই মারমাকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেন হৃদয়ের পিতা। মুক্তিপণের দেড় লাখ টাকা একাই নেন উচিংথোয়াই মারমা। বাকি ৫০ হাজার টাকা অন্যদের ভাগ করে দেয় বলে গ্রেফতারকৃতরা আদালতে জবানবন্দিতে স্বীকারোক্তি দেন।
এ ঘটনায় হৃদয়ের মা নাহিদা আক্তার বাদি হয়ে রাউজান থানায় প্রাথমিকভাবে অপহরণ মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে আদালতে দেয়া জবানবন্দি অনুসারে হৃদয়কে হত্যার বিষয়টি উদঘাটিত হলে অপহরণ মামলার ধারার সঙ্গে হত্যা মামলা সংযুক্ত করা হয় বলে জানান রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল হারুন।
উল্লেখ্য, এ ঘটনায় ১০ সেপ্টেম্বর নগরীর চান্দগাঁও থানা এলাকা সুইচিংমং মারমা (২৪), অংথুইমং মারমা (২৫) ও উমংচিং মারমাকে (২৬) গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে পরদিন (১১ সেপ্টেম্বর) উমংচিং মারমাকে নিয়ে হৃদয়ের মরদেহ উদ্ধার করতে যায় পুলিশ। এদিন কদলপুর-রাঙ্গুনিয়া সীমান্তবর্তী দলুছড়ি পাহাড়ি এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে অপহৃত যুবক হৃদয়ের খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে ফেরার পথে পঞ্চপাড়া গ্রামে কয়েকশ মানুষ জড়ো হয়ে পুলিশের গাড়ি আটকে দেয়। এ সময় উত্তেজিত জনতা গাড়ি থেকে আসামি উমংচিং মারমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। আসামি ছিনিয়ে নিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশ দুটি মামলা দায়ের করে।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে তাদের সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।