সুপ্রভাত রিপোর্ট :
নি¤œস্ল্যাবের এক হাজার শলাকা সিগারেটের মূল্য ৩৯শ টাকা। যাতে কোম্পানির উৎপাদনসহ যাবতীয় খরচ, লাভ ও রাজস্ব রয়েছে। কিন্তু ৪শ টাকা ছাড়ে বিক্রি করা হচ্ছে ৩৫শ টাকায়। বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড (বিএটি) ও জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) এর বিরুদ্ধে সিগারেট বিক্রিতে এমন কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। দুইটি বহুজাতিক কোম্পানি মূলত অনাকাঙ্খিত বাজার বৈষম্য সৃষ্টি ও ছোট কোম্পানিগুলোকে ধ্বংস করতে এমন কারসাজি করা হচ্ছে। সম্প্রতি একটি দেশীয় সিগারেট কোম্পানির অভিযোগের ভিত্তিতে কুমিল্লা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে লিখিত অভিযোগ করে। এরই প্রেক্ষিতে কমিশনারেট বাজার যাচাই করে এর সত্যতা পায়। পরে কমিশনারেট থেকে ব্যবস্থা নিতে প্রমাণসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়। সে চিঠির আলোকে এনবিআর কাজ শুরু করেছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৬-৭ অর্থবছর পর্যন্ত দেশীয় সিগারেট কোম্পানি ছিল ১৫টি। আর বহুজাতিক কোম্পানি ছিল শুধু বিএটি। মোট সিগারেট বাজারের ৭০ শতাংশ ছিল দেশীয় কোম্পানির। আর বিএটি’র ছিল ৩০ শতাংশ। নি¤œস্ল্যাবের সিগারেটের শতভাগ বাজার ছিল দেশীয় কোম্পানির। বর্তমানে দেশীয় ২৪টি ও বহুজাতিক দুইটি কোম্পানির নি¤œস্ল্যাবের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করে। দেশীয় কোম্পানির মধ্যে হাতেগোনা ৪-৫টি কোম্পানি উৎপাদনে রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৪ বছরের ব্যবধানে নি¤œস্ল্যাবের সিগারেটের দেশীয় কোম্পানির বাজার হিস্যা মাত্র ৯ শতাংশ। আর দেশীয় কোম্পানির নি¤œস্ল্যাব সিগারেট বিক্রির পরিমাণ মাত্র ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অপরদিকে দুইটি বহুজাতিক কোম্পানির বাজার হিস্যা ৯১ শতাংশ। তাদের নি¤œস্ল্যাবে সিগারেট বিক্রির পরিমাণ ৮৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। কমিশনারেটের চিঠিতে বলা হয়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নি¤œস্তরের সিগারেট ৩৯শ টাকার স্থলে ৩৫শ টাকায় অর্থাৎ প্রতি হাজার শলাকায় ৪শ টাকা কম দামে বিক্রি করছে। কুমিল্লা ভ্যাটের অধীক্ষেত্রাধীন সিগারেট উৎপাদনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড (একেটিসিএল) লিখিত অভিযোগ করেছে। অভিযোগের সত্যতার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে একেটিসিএল এর শুধু বিক্রি হ্রাস পায়নি, পাল্লা দিয়ে হ্রাস পেয়েছে এ খাতের রাজস্ব। আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯-২০ অর্থবছর মোট ১হাজার ৭শ৯৭ কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করেছে, যা কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনারেটের মোট আহরিত রাজস্বের ৬২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবুও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় এ প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আহরণ হ্রাস পেয়েছে ১শ৬০ কোটি ৮০ লাখ টাকা; যা প্রবৃদ্ধির হিসেবে ৮ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি ৭শ৮৬ কোটি ২৩ লাখ শলাকার বিপরীতে রাজস্ব দিয়েছে ১হাজার ৯শ৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আর ট্রেজারিতে জমা দিয়েছে ১হাজার ৯শ৫৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর ৭শ১৪ কোটি ৮৩ লাখ শলাকার বিপরীতে রাজস্ব দিয়েছে ১হাজার ৮শ৫৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। আর ট্রেজারিতে জমা দিয়ে ১হাজার ৭শ৯৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। চিঠিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির চিঠি, এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা ও বাজার জরিপে সমজাতীয় পণ্য উৎপাদনকারী ২৪টি দেশীয় নি¤œস্তরের সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেখা যায়। পাশাপাশি কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানিও নি¤œস্তরের সিগারেট উৎপাদন করে, যা যাচাই করা হয়। যার মধ্যে বিএটি ও জেটিআই অন্যতম। সম্প্রতি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নি¤œস্তরের সিগারেট বাজারজাত করছে।অভিযোগে বলা হয়েছে, উৎপাদন খরচ একই হওয়া সত্ত্বেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো উৎপাদিত নি¤œস্তরের সিগারেট দেশীয় প্রতিষ্ঠানের তুলনায় প্রতি হাজার শলাকায় ৪শ টাকা কমে বিক্রি করে আসছে। প্রতি হাজার শলাকা সিগারেটের উৎপাদন, বিক্রি এবং মুনাফা সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায়, প্রতি হাজার শলাকা নি¤œস্তরের সিগারেট উৎপাদনে দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানি বিএটি, জেটিআই এর উৎপাদন ও বিক্রি খরচ তিন হাজার ৮শ৬২ টাকা এক পয়সা। এর মধ্যে মৌলিক কাঁচামাল ৩শ৪২ টাকা ২৮ পয়সা, উৎপাদন খরচ ৭১ টাকা ৫৮ পয়সা, প্রশাসনিক খরচ ৩৪ টাকা, বিপনন খরচ ৩শ৬৫ টাকা, সুদ ও অন্যান্য ১শ৯১ টাকা ৬২ পয়সা, সারচার্জ (১%) ১০ টাকা ৫৩ পয়সা এবং সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও স্বাস্থ্য কর ৭৩ শতাংশ হিসেবে দুই হাজার ৮শ৪৭ টাকা।আরও দেখা যায়, দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির নি¤œস্তরের এক হাজার শলাকা সিগারেটের উৎপাদন খরচ হয় তিন হাজার ৮শ৬২ টাকা এক পয়সা। কিন্তু এক হাজার শলাকা সিগারেট দেশীয় কোম্পানির বিক্রি করে তিন হাজার ৯শ টাকা। কিন্তু উৎপাদন একই হওয়া সত্ত্বেও দুইটি বহুজাতিক কোম্পানি একই সিগারেট ৪শ টাকা কম দামে বিক্রি করছে তিন হাজার ৫শ টাকা। কম মূল্যের সাথে বহুজাতিক কোম্পানির ব্র্যান্ড ইমেজ ও পণ্যের গুণগতমানের কারণে তাদের বিক্রি পরিমাণ ও পরিসর স্বভাবতই বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে নি¤œস্তরের দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সিগারেটের চাহিদা কমে যাওয়ায় তাদের সামগ্রিক উৎপাদন, সরবরাহ আগের বছরের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে। একেটিসিএল‘র মতো দেশীয় কোম্পানিগুলোর সাথে বহুজাতিক কোম্পানির অনাকাঙ্খিত বাজার বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে দেশীয় সিগারেট শিল্প বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে, দেশীয় কোম্পানির ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি কমে গেছে, বিক্রির সাথে রাজস্ব জ্যামিতিক হারে হ্রাস পেয়েছে, কমিশনারেটের লক্ষ্যমাত্রা মারাত্বকভাবে বিঘিœত হয়েছে। স্থানীয় সিগারেট শিল্প বন্ধ হলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বেকারত্ব বাড়বে।চিঠিতে আরও বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে নি¤œস্তরের সিগারেটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি হাজার শলাকা তিন হাজার ৯শ টাকা। সম্পূরক শুল্ক ৫৭ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, সারচার্জ ১ শতাংশসহ মোট করহার ৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ মোট করের পরিমাণ প্রতি হাজার শলাকায় দিতে হয় দুই হাজার ৮শ৪৭ টাকা। প্রতি হাজারে কর পরবর্তী কন্ট্রিবিউশন বা আয় (৩৯শ-২হাজার ৮শ ৪৭) বা এক হাজার ৫৩ টাকা। দুইটি বহুজাতিক কোম্পানি প্রতি হাজারে ৪শ টাকা কমে তিন হাজার ৫শ টাকায় নি¤œস্তরের সিগারেট বাজারজাত করছে। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে ৪শ টাকা লোকসান দিয়ে একই দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতি হাজার শলাকা সিগারেট বিক্রির ক্ষেত্রে নিট ৩শ৬২ টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যহত হলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও বিঘিœত হবে। পাশাপাশি দেশীয় বিনিয়োগ অরক্ষিত হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে নি¤œস্তরের সিগারেট বিক্রিতে বাজারে সমতা রক্ষা, দেশীয় সিগারেট শিল্পে ও এতে কর্মজীবীদের শিল্প রক্ষার লক্ষ্যে বিড়ির মতো পৃথক স্তর সৃষ্টি, সংরক্ষণ, যেকোন প্রকার বাট্টা বা মূল্যহ্রাস প্রদানের ক্ষেত্রে এনবিআর পূর্বানুমতি বাধ্যতামূলক করা, নি¤œস্তরের সিগারেট বিক্রির মূলে আপাতত দৃশ্যমান সকল মূল্য বৈষম্য দূর, স্থানীয় সিগারেট শিল্প ও বিনিয়োগ রক্ষায় পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো সিগারেট শিল্পের জন্য সূদুরপ্রসারী নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, দেশীয় কোম্পানিকে রক্ষায় দুইটি কোম্পানির মূল্য কারসাজির বিষয়ে খতিয়ে দেখতে এনবিআরকে অনুরোধ জানানো হয়।এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এ নিয়ে কাজ চলছে। তবে এখানে আইনের কোন ব্যতয় হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি ব্যতয় হয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’এ বিষয়ে বিএটি’র হেড অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স শেখ শাবাব আহমেদ বলেন, ‘ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটি বাংলাদেশ) দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। সিগারেট শিল্পের সিংহভাগ রাজস্ব বিএটি বাংলাদেশ এককভাবে দিয়ে থাকে। বাজেটে নির্ধারিত সিগারেটের স্তরভেদে যে সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাট নির্ধারিত হয়েছে, তা বিএটি বাংলাদেশ সঠিকভাবে প্রদান করে আসছে। এই বিষয়ে বৃহৎ করদাতা ইউনিট-মূল্য সংযোজন কর (এলটিইউ-ভ্যাট) সার্বক্ষনিক তত্ত্বাবধান করছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিএটি বাংলাদেশ সবসময় ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে।’এ বিষয়ে জেটিআই এর হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স শেজামি খলিল বলেন, ‘যেসকল দেশে জেটিআই-এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, সে সকল দেশের প্রচলিত আইন এবং নীতিমালা যথাযথভাবে মেনে চলতে জেটিআই অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি এবং এ কারণেই জেটিআই বাংলাদেশের সকল প্রচলিত জাতীয় আইন মেনেই তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’