নিজস্ব প্রতিবেদক »
মিরসরাই উপজেলার মিঠাছড়া বাজারের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গাপুর গ্রামে জন্ম জাহেদ হোসেনের। সেখানে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। কিন্ত দশমশ্রেণিতে উঠে থেমে যায় সবকিছু। অস্টিওআর্থাইটিসের কারণে তার জয়েন্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারাজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় তার চলাফেরা। এভাবে হুইল চেয়ারে ১২ বছর পার করেন তিনি। পরে ২০২০ সালের শুরুর দিকে ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ ডেভেলমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ‘ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলমেন্ট’র উপরে তিন মাস কোর্স করেন। এখন তিনি কানাডার ওয়েলনেস কোম্পানিতে স্থায়ীভাবে চাকরি করছেন।
জাহেদ হোসেনের পথচলা এতটা মসৃণ ছিলো না। হুইল চেয়ারে কাটানো ১২ বছরের দিনগুলোর বর্ণনায় আবেগ প্রবণ হয়ে তিনি বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকায় আমি এসএসসির গ-িও পার করতে পারিনি। প্রতিনিয়ত আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী সবাই খাটো করে দেখতে থাকলেন। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র থেকে ধীরে ধীরে আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়া হলো। চার দেওয়ালই হয়ে উঠলো আমার স্থায়ী ঠিকানা। এভাবে থাকতে থাকতে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হচ্ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমার এসব থেকে বের হতে হবে। কিছু করতে হবে। কিভাবে বের হবো তা ভাবতে থাকি। হাতে একটা ট্যাব থাকায় সুবিধা হলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে হঠাৎ একদিন ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখতে পায়। জানলাম ফ্রি প্রশিক্ষণের কথা। কিন্ত সেই প্রশিক্ষণ করতে লাগে এইচএসসি পাসের যোগ্যতা।
এটা দেখে আবার ভেঙে পড়ি। পরে একদিন সাহস করে ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি আমার আগ্রহের কথা তাদের জানায়। তারাও আমাকে নিরাশ করেন নি।
জাহেদ হোসেনের বাবা আবুল কালাম একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ২০২০ সালের দিকে মারা যান। তারা তিন ভাই বোন। ভাই ঢাকায় একটি কোম্পানিতে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কর্মরত আছেন। বোনের বিয়ে হয়েছে। মাকে নিয়ে তিনি গ্রামে থাকেন। সেখানে বসেই বর্তমানে কানাডার ওয়েলনেস কোম্পানিতে স্থায়ীভাবে চাকরি করছেন।
প্রশিক্ষণের দিনগুলোর বর্ণনায় জাহেদ বলেন, করোনার আগে আমি কোর্সে ভর্তি হয়। তখন অন্যরা স্বশরীরে ক্লাস করতো। কিন্ত আমার তো যাওয়ার কোনো উপায় নেই। হাঁটতেই তো পারি না। সব ক্লাশ অনলাইনে করেছি। সেই সকাল ৯টায় ক্লাশ শুরু হতো, আর শেষ হতো বিকাল ৪টায়। ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের সব আগের ক্লাসের ভিডিওগুলো দেখতাম। প্রায় ৮ মাস নিরলস শ্রম দিয়েছি শিখতে। কাজ শেখার পর বাধলো বিপত্তি। ব্যক্তিগত কম্পিউটার ছিলো না। বাবা-মাকেও বলার মতো অবস্থা ছিলো না। কারণ আমি অক্ষম। আমার পেছনে ৫০-৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে, সেটা উঠাতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ছিলো। পরে কাছের এক বড় ভাই আমাকে পুরোনো ল্যাপটপ দেন। সেই শুরু, প্রথমে আমেরিকার একটা কøায়েন্টের কাজ করায় ৫ ডলার আয় করি। এভাবে যেতে যেতে আমার আয় দিয়ে সবকিছু কিনে ফেললাম।
তিনি আরও বলেন, আজকে প্রায় তিন বছর আমি কানাডার কানাডার ওয়েলনেস কোম্পানিতে স্থায়ীভাবে চাকরি করছি। গত সপ্তাহে আবার ইউএস’র এক কোম্পানিতে অস্থায়ী কাজ হলো। আমি তাদের বলেছি আমার একটা জব আছে, এত সময় তো নেই। তারা পুরোনো ক্লায়েন্ট। আমার কাজ ভালো লাগায় ইউএস’র কোম্পানি অনুরোধ করেছেন। যেন আমার কাজ শেষ হলে তাদের কয়েক ঘণ্টা সময় দিই। সব মিলিয়ে আমার এখন সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকার উপর বেতন। এখন পরিবারে টাকা দিতে পারি। অনেক ভালো আছি এখন।
নতুনদের নিয়ে তিনি বলেন, যারা ফ্রিল্যান্সারের কাজ করতে আগ্রহী তাদের অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হবে। শেখার শুরুতে কাজ না আসায় অনেকে হতাশ হয়ে যান। কিন্ত এটা হতে দেওয়া যাবে না। ধৈর্য, পরিশ্রম, সময় দিয়ে এগুতে হবে। তবেই সফলতা ধরা দিবে।
জাহেদ হাসানের মত চট্টগ্রামে প্রায় ১৪ হাজার ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ ডেভেলমেন্ট প্রকল্পে বিনামূল্য কোর্স করেছেন। সেখানে থেকে সর্বোচ্চ আয় করা ১১০ জনের মাঝে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে গতকাল লেডিস ক্লাবে ল্যাপটপ ও সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়। এছাড়া ১৪০০ প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়।