নিজস্ব প্রতিবেদক »
লাগামছাড়া খাদ্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম। বেঁচে থাকতে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন সাধারণ মানুষ। সকাল-বিকালের নাস্তা থেকে শুরু করে তিন বেলার খাদ্যপণ্য-চাল, ডাল, তেল, ডিম, ব্রয়লার মুরগি, চিনি, লবণ ও আটা-ময়দার দাম বাড়ছেই। হাঁড়ি-পাতিল সেগুলোরও দাম বেড়েছে। রান্নায় অপরিহার্য উপাদান আগুন সেটা জ্বালাতে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। এমনকি সাবান-শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট সবকিছুর দাম এখন আকাশছোঁয়া। কোনকিছুর দাম থেমে নেই।
সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ-বই, খাতা ও কলমের দামও বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি সাধারণ মানুষের আয়। এতে সংসারের বাড়তি খরচ সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছেন সব শ্রেণির মানুষ।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য পণ্য সবকিছুর দাম বাড়তি। সকাল ও বিকালের নাস্তা তৈরির উপকরণের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে আয় না বাড়লেও সব শ্রেণির মানুষের ব্যয় বাড়ছে। তাই পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে বেড়েছে কিনা তা সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে। কোনো অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় আনতে হবে।
শুক্রবার বন্দরনগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, বহদ্দারহাট ও বক্সিরহাট কাঁচাবাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দিন প্রতি কেজি সরু চাল (নাজির/ মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ৬০ টাকা ছিল।
খাতুনগঞ্জের খুচরা বাজারে মোটা চাল (স্বর্ণা/চায়না/ইরি) বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, যা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ছিল ৪২ থেকে ৪৮ টাকা ছিল। খোলা সয়াবিন তেল (লুজ) ১৬৫ থেকে ১৭০, পাম অয়েল (লুজ) ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা, পাম অয়েল (সুপার) ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। সরকারের নির্ধারিত দামকে উপেক্ষা করে ব্যবসায়ীরা মনগড়া দামে বিক্রি করছে। অন্যদিকে প্রতি কেজি চিনি ৯৫ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক মাস আগে ৭৫ টাকা ছিল।
প্রতি কেজি প্যাকেট লবণ ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৩৫ টাকা ছিল। প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৫০ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৭৫ টাকা।
বিভিন্ন এলাকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় আকারের পাউরুটি বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা। যা আগে ৮০-৮৫ টাকা ছিল। ৩০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট চানাচুর বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা। যা আগে ৭৫ টাকা ছিল। ৮ পিসের প্যাকেট নুডুলস বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা। যা আগে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এনার্জি বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা, যা আগে ৩৮ টাকা ছিল। ১০ টাকা বেড়ে পাইনাপেল বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা।
প্রতি কেজি টোস্ট বিস্কুট ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা। প্রতি লিটার কোক ৫ টাকা বেড়ে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৬০০ গ্রাম ওজনের প্রাণ সসের বোতল ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আগে ৬২ টাকা ছিল।
এদিকে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া এক কেজির ওয়াশিং পাউডার এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইউনিলিভারের রিন পাউডার মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা হয়েছে। ৫০০ গ্রামের সার্ফ এক্সেল দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১০৫ টাকা যেটা বর্তমানে ১৪০ টাকা। আবার ৩২০ মিলিগ্রামের সানসিল্ক শ্যাম্পুর দাম বর্তমানে ৪৬০ টাকা, যেটা কয়েকদিন আগেও সর্বোচ্চ ৩৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
২০০ মিলির জিলেট শেভিং জেলের মূল্য ২৫০ টাকার পরিবর্তে ৩২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে ২০০ গ্রাম ওজনের সব ব্র্যান্ডের টুথপেস্টে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। ২০০ গ্রাম ওজনের কোলগেট টুথপেস্টের দাম ১৩০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে কথা হয় রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মাসুদ রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাড়তি দামে পণ্য কিনে হোটেল চালাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক কর্মীকে ছাঁটাই করেছি। এভাবে সবকিছুর দাম বাড়লে হয়তো ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।
বহদ্দারহাটে আসা শফিউল আলম নামক এক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বলেন, সবকিছুর ব্যয় বহন করে টিকে থাকা এখন যেন দায়। বাজারে এমন কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না যার দাম বাড়েনি। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে সাবান, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট সবকিছুর দাম বাড়তি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা উপকরণসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। এমনকি সকাল ও বিকালের নাস্তা জোগাড় করতেও বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তাই ব্যয় সামলাতে পণ্য কেনা ও খাওয়ায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এমন অবস্থা আর কতদিন চলবে জানি না।
ইউনিলিভারের সিএফও জাহিদ বলেন, আমাদের কোম্পানির অনেক পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে এটা সত্য। তবে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াইনি। আমাদের শিল্পের যে পণ্যগুলো আছে তা উৎপাদন করতে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ডিটারজেন্টের ক্ষেত্রে ৫০০ গ্রামের রিম পাউডার ২০২০ সালে ছিল ৬০ টাকা। এখন ৯০ টাকা। সেক্ষেত্রে বলতে পারেন ৫০ শতাংশ দাম বেড়েছে। তবে এটা তৈরি করতে আমাদের ৯৬ শতাংশ খরচ বেড়েছে। এই ওয়াশিং পাউডার তৈরিতে দরকার হয় সালফনিক অ্যাসিড। সেটা কোয়াটার-৪ ২০-২০ কিনতে হয় প্রতি কেজি ৮৩ টাকা। এখন এই মুহূর্তে এটা কিনছি ১৯০ টাকা প্রতি কেজি। এটা আমরা চায়না থেকে আনি।
আরেকটা হলো সোডা ও সালফিউরিক অ্যাসিড। সেটা ২১ টাকা প্রতি কেজি কিনতাম। এখন কিনতে হয় ৫৭ টাকায়। সোডিয়াম সালফেড কিনতে সরকার ডিউটি বাড়িয়েছে ১৫০ শতাংশ। সাবান তৈরির প্রধান উপকরণ ভেজিটেবল অয়েল।
এটা ৯০ টাকা প্রতি কেজি কিনতাম তা এখন ১৮০ টাকায় মালয়েশিয়া থেকে কিনতে হচ্ছে। সব মিলে আমাদের পণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে। তবে কাঁচামালের দাম কমলে দেশের বাজারে তৈরিকৃত পণ্যের দাম কমানো হবে।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি শিক্ষা উপকরণের দাম ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। বাঁধাই করা ৪০ টাকার কাগজের খাতা ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি ডজন কলম ১০ টাকা বেড়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি এক রিম কাগজের দাম ছিল ৩২০ টাকা, সেটি এখন ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বাড়ানো হয়েছে। ১২ কেজির প্রতিটি সিলিন্ডারের দাম ১৬ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে ভোক্তাদের ১২ কেজির প্রতিটি এলপিজি সিলিন্ডার এখন থেকে ১২৩৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইসএম সফিকুজ্জামান বলেন, সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অধিদপ্তর থেকে সার্বিকভাবে তদারকি করছি। এমনকি সব খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অধিদপ্তরে সভা করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছি। দাম কমাতে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছি। অনিয়ম পেলে দোষীদের আইনের আওতায় আনছি।
তিনি আরো জানান, আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে নিত্যপণ্যের মধ্যে সাবান, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট এ সবের দাম বেড়েছে। এই শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৯৫ টাকার ডলার কিনতে ১১০ টাকা ব্যয় করছেন। সব ঠিক আছে। কিন্তু ৩০ টাকার পণ্য ৫০ টাকায় বিক্রি করা অযৌক্তিক।
ভোক্তাদের পক্ষ থেকে আইনে আমাদের অধিদপ্তরকে ভোক্তার স্বার্থ দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হবে।