নিজস্ব প্রতিনিধি, হাটহাজারী »
হালদা নদীতে মা মাছ এখনো পর্যন্ত প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম ডিম ছাড়ায় হতাশ ডিম সংগ্রহকারীরা। তবে তারা এখনও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন নদীর পাড়ে। গত সোমবার (১৬ মে) রাতের বৃষ্টিতে হালদা নদীতে আবারও ডিম দেয় মা মাছ। এ সময় নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে তিন শতাধিক নৌকা ও বাঁশের ভেলায় বসে জাল ফেলে ডিম আহরণ করেন সংগ্রহকারীরা। তবে পরিমাণে অনেক কম।
গত রোববার দিবাগত রাত ৩টায় বৃষ্টিপাত হলে মা মাছ নমুনা ডিম ছাড়তে শুরু করে। পরে সোমবার ভোরে বিভিন্ন স্থানে নমুনা ডিমের চেয়ে একটু বেশি ডিম ছেড়েছে মা মাছ। গতকাল মঙ্গলবারও নদীর বিভিন্ন স্থানে ডিম ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা। তবে এ বছর হালদা নদীতে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন ডিম সংগ্রহকারীরা। প্রতি বছর কার্প জাতীয় রুই, কাতলা, মৃগেল, কালি বাউশসহ মা মাছ ডিম দেয়।
গতকাল সন্ধ্যার দিকে হাটহাজারী উপজেলার মধ্যম মাদার্শা এলাকার ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়ুয়া সুপ্রভাতকে বলেন, এবার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গত কয়েকদিন ধরে নদীতে ছিলাম। রোববার রাতে বজ্রসহ বৃষ্টি হয়েছিল। এরপর ভোরে মা মাছ ডিম ছাড়ে অল্প পরিমাণে। এবার ছয়টি নৌকায় সব মিলে ডিম পেয়েছি তিন বালতির মত ডিম। নদীতে মা মাছের আনাগোনা আছে। আশা করি আগামী অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় আবার ডিম ছাড়বে। তখন যদি কিছু ডিম পাওয়া যায় সে আশায় থাকলাম।
ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর সুপ্রভাতকে বলেন, নদীতে পাথর ব্লক ফেলে কুম ভরাট করে ফেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিম পাওয়া যায়নি।
ডিম সংগ্রহকারী মুন্সিদাশ বলেন, হতাশা নিয়ে নদী থেকে উঠে যাচ্ছি। ডিম পাইনি, কি করে নৌকা ভাড়াসহ খরচ পোষাব বুঝতে পারছি না। হালদা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের পাথর ব্লকই কাল হয়েছে বলে দাবি তার।
এদিকে শত শত ডিম সংগ্রহকারী সোমবার ভোর থেকে নৌকা ও সরঞ্জাম নিয়ে নদীর হাটহাজারী ও রাউজান অংশের আজিমের ঘাট, অংকুরি ঘোনা, ছায়ার চর, কাগতিয়ার মুখ, গড়দুয়ারা, নয়াহাট, রাম দাশ মুন্সির ঘাট, মাছুয়া ঘোনা ও সত্তার ঘাট অংশে ছিলেন অপেক্ষায় ছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিম না পাওয়ায় বেশির ভাগই হয়েছেন হতাশ।
হালদায় মা মাছের ডিম না পাওয়ার কারণ হিসেবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের ডিম ছাড়ার বিশেষ স্থান নদীর কুম (গভীর এলাকা) ভরাটকে দায়ী করছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী ও ডিম সংগ্রহকারীরা। তাদের দাবি, নদীর অঙ্কুরিঘোনা থেকে রামদাশ হাট পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে এসব কুম। কিন্তু নদীর পাড় রক্ষা ও ভাঙন রোধে এসব কুমের মধ্যে জিও ব্যাগ ফেলায় অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে এসব। ফলে প্রজনন মৌসুমে এসব কুমে পানির স্রোত কমে গেছে। যে কারণে মা মাছ এখানে ডিম ছাড়েনি। অন্যদিকে বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিম পাওয়া যায়নি বলে দাবি হালদা বিশেষজ্ঞ, উপজেলা প্রশাসন ও ডিম সংগ্রহকারীদের।
ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, তারা ২৫০ গ্রাম থেকে আধাকেজি পর্যন্ত ডিম পেয়েছেন। বেশকিছু স্থানে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশের নমুনা ডিম পাওয়া যাচ্ছে। এরমধ্যে হাটহাজারীর রামদাস মুন্সিরহাট, মাছুয়াঘোনা, নাপিতের ঘাট, আমতুয়া, নয়াহাট, রাউজানের আজিমের ঘাট, খলিফারঘোনা, ছায়ার চর এলাকায় ৫শ’ থেকে ৭শ’ গ্রাম করে ডিম পাওয়া গেছে। আবার কোথাও কোথাও কয়েক কেজি ডিম পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন তারা। যে সব ডিম পাওয়া গেছে সেগুলো হ্যাচারিতে পরিচর্যা করা হচ্ছে।
চট্রগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম সুপ্রভাতকে বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতে গত সোমবার রাতে যে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে তা সোমবার ভোরে প্রাপ্ত নমুনা ডিমের পরিমাণ থেকে কিছুটা বেশি ছিল কারণ গত সোমবার রাতে পাহাড়ে সামান্য বৃষ্টিপাত হওয়ায় বিভিন্ন শাখা খালের মাধ্যমে হালদা নদীতে সামান্য পরিমাণে ঢল নেমে আসে তাই নদীতে মা মাছ স্মল স্কেলে ডিম ছেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, হালদার বিভিন্ন পয়েন্টে নমুনা ডিম থেকে সামান্য বেশি পরিমাণে ডিম ছাড়ায় অনেক ডিম সংগ্রহকারী ডিম সংগ্রহ করতে না পেরে হতাশ। যেহেতু গতকাল রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়নি, এছাড়া বায়ুর ও পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক থেকে বেশি হওয়ায় মা মাছ অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে লার্জ স্কেলে ডিম দেয়নি। তবে পরিবেশ অনুকূলে হলে অর্থাৎ পর্র্যাপ্ত পরিমাণে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হলে পরবর্তী (২৮ থেকে ৩১) মে অথবা (১৩ থেকে ৩) জুন লার্জ স্কেলে ডিম দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহিদুল আলম বলেন, হালদা নদীর মা মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমরা মাঠে ছিলাম, আছি। এরপরও প্রত্যাশিত ডিম পাওয়া যায়নি বলে ডিম সংগ্রহকারীরা জানাচ্ছেন। বজ্রপাতসহ মুষলধারে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ডিম কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে এখনো ডিম সংগ্রহকারীরা আশায় আছেন।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালেও হালদায় দুই দফায় মোট আট হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। এর আগের বছর ২০২০ সালে ২২ মে ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। সেসময় আনুমানিক সাড়ে ২৫ হাজার কেজির বেশি ডিম সংগ্রহ হয়, যা ছিল ২০০৬ সালের পর সর্বোচ্চ।