নিজস্ব প্রতিবেদক <<
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দিন দিন বিলীনের পথে। এসব সংস্কৃতির অন্যতম একটি অংশ হচ্ছে ‘মেলা’। নাম শুনলেই কোমল অনুভূতি শিহরিত করে শরীরকে। মনকে করে তোলে রশিক। কিন্তু করোনা ভাইরাসের ভয়াল তাণ্ডবে সে অনুভূতি থমকে গেছে। বন্ধ হয়েছে চট্টগ্রামের সকল ঐতিহ্যবাহী মেলা। হচ্ছ না পহেলা বৈশাখের উৎসবও। তার সাথে হারিয়ে যেতে চলেছে এরই অংশ কুমারের মাটির তৈরি তৈজসপত্র বা মৃৎশিল্প।
পৌষ মাস থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় মেলা। চলে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। তার আগে থেকে ব্যস্ততার ধুম লাগে কুমার পাড়াগুলোতে। তৈরি হয় মাটির থাল-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল, গরু-ঘোড়া, ফুলদানিসহ গৃহস্থলি সামগ্রী। কিন্তু এ বছরে এসব তৈরি হলেও থেকে গেছে পাইকারের গোডাউনে অথবা কুমারের উঠানে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের আধিক্যতার কারণে সরকারি নির্দেশনায় বন্ধ রাখা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন মেলা ও জব্বারের বলিখেলা। এরই সাথে ভেঙে গেছে কুমারদের স্বপ্ন মেলা ঘিরে সকল অকাঙক্ষা। যার ফলে কুমারের মাটির তৈরি তৈজসপত্রে নেমেছে কাল। মেলা না থাকায় মৃৎশিল্প ব্যবসায়ীরা নেমেছে নগরের রাস্তায়। সচরাচর নগরে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দেখা মেলে না। মৃৎশিল্পের পণ্য কিনতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো মেলার। কিন্তু তা এখন ভ্যানে উঠেছে, হারিয়ে যেতে ক’দিন বাকি।
নগরের টেরিবাজার এলাকায় ভ্যানগাড়ী নিয়ে মৃৎশিল্পের পণ্য বিক্রেতা গৌতম পালের সাথে দেখা মিলে। করোনা মহামারি শুরুর আগে নগর গ্রামের বিভিন্ন মেলায় স্টল দিয়ে বিক্রয় করতের মাটির তৈরি পণ্য। কিন্তু করোনার প্রকোপ বাড়ার কারণে সকল মেলা বন্ধ থাকায় জীবন বাঁচাতে ও জীবিকার তাগিদে ভ্যান নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। ভ্যান দাঁড় করাতেই লোকজন ভিড় করছিলেন তার ভ্যানে। গত দুই বছরের মাটির জিনিসপত্র কেনার আক্ষেপ পোষাতে যেন তারা হুমরে পড়েছে এ ভ্যান গাড়িতে। মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল ছাড়াও তার ভ্যানে দেখা মেলে মেলায় বিক্রয়ের জন্য তৈরি মাটির ব্যাংক, নৌকা, পাখি, ঘোড়া, হাতি, গরু, ফুলদানি, নজরুলসহ বিভিন্ন গুণী জনের ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন গৃহস্থলি জিনিসপত্র। তাছাড়া টেরিবাজারে ঈদ বাজার করতে আসা মানুষজনও ঝুকেছে তার ভ্যানের দিকে। কারণ বাংলা নববর্ষ। যে উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। এদিনে মানুষজন হতে চাই পুরো দমে বাঙালি। আর এ সাজের সাথে মাটির জিনিসপত্রেরও এক গভীর মিতালি রয়েছে। অন্যদিকে বিক্রেতা গৌতমের ধারণা এ ঐতিহ্যকে বাঁচাতে হলে সরকারি সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। যদি তা না হয় হারিয়ে যেতে পারে এ শিল্প।
ভ্যান থেকে মাটির বাসন ক্রয়ের সময় এক চাকুরিজীবী নারী জেসি বড়ুয়া সুপ্রভাতকে বলেন, ‘মাটির তৈরি এসব জিনিস আমাদের ঐতিহ্য। তাছাড়া বাংলা নববর্ষের দিন ঘরে বসে অন্তত বাংলার সংস্কৃতিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। আমাদের ছোট ছেলে মেয়েদের যদি এসব না চেনায় তবে হারিয়ে যেতে পারে এ ঐতিহ্য। তবে ঘর সাজানো ও নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে মাটির জিনিসপত্র দেখতে যেমন সুন্দর লাগে তেমনই ব্যবহারে তৃপ্তি লাগে।’
অন্য একজন ক্রেতা আশিক হামিদ বলেন, ‘এসব মাটির পণ্যর সাথে বাঙালির গভীর আত্মার সম্পর্ক আছে। তাছাড়া এসব দেখলে ছোট বেলার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। বাবার হাত ধরে মেলায় ঘুরা। তবে এ বুড়ো বয়সে এসেও এসব জিনিসপত্র দেখে কেনার লোভ সামলানো বড় কঠিন।’
মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী গৌতম পাল সুপ্রভাতকে বলেন, ‘বরিশালের পটুয়াখালী থেকে এসব মাটির তৈরি জিনিসপত্র এনে বিভিন্ন মেলায় ব্যবসা করতাম। কিন্তু গত বছর করোনার শুরু থেকে সকল মেলা বন্ধ থাকায় চলছে না ব্যবসা। রাস্তায় নামতে হয়েছে ভ্যানগাড়ি নিয়ে। কোনভাবে ধরে রেখেছি বাপ দাদার ব্যবসা। মেলা না হওয়ায় বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মেলা না হলেও, এ ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। তা না হলে যে কোন সময় বিলীন হয়ে যাবে এ শিল্প।’