হাতির কেন ছোট চোখ

অনুবাদ : মোস্তাফিজুল হক

একসময় আম্বো ছিলেন কালাবারের রাজা। তখন হাতি ছিল যেমন বড় প্রাণি, তেমনি তার দেহের অনুপাতে চোখও ছিল অনেক বড়। সে সময়ে মানুষ আর প্রাণিরা ছিল পরস্পরের বন্ধু। ফলে সবাই একসাথে অবাধে মিলেমিশেই থাকতো। রাজা আম্বো মাঝে মাঝেই এক মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করতেন। হাতি সেই ভোজ অনুষ্ঠানে সবার চেয়ে বেশি খাবার খেতো। কচ্ছপও এই কাজে সেরাদের কাতারেই ছিল। তবে হাতির মতো বড় নয় বলে আর খুব ধীর গতির হওয়ায় সে অনেক পেছনে পড়ে থাকতো।

হাতি এই উৎসবে খুববেশি খায় বলে কচ্ছপ খুব বিরক্ত। ছোট হলেও চতুর কচ্ছপ মনেমনে সিদ্ধান্ত নিলো যে, হাতিকে তার পাওনা অংশের চেয়ে বেশি খাবার খেতে দেবে না। তাই সে একটা থলেতে খৈইল আর শুকনো চিংড়ি ভরে রাখলো। হাতির এসব খাবার খুব পছন্দের। এরপর সে থলে নিয়ে বিকেলে হাতির বাড়িতে গেল।

কচ্ছপ হাতির বাড়িতে পৌঁছালে হাতি তাকে বসতে বললো। সে আরাম করে বসলো। এরপর সে এক চোখ বুজে থলে থেকে এক টুকরো পাম খৈল আর একটি চিংড়ি মাছ বের করে খুব মজা করে খেতে শুরু করলো।

হাতি কচ্ছপকে খেতে দেখে ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে বললো, ‘মনে হয় থলের ভেতরে ভালো কিছু খাবার আছে। তুমি কী খাচ্ছো, ভাই?’

কচ্ছপ জবাবে বললো, ‘আমি যা খাচ্ছি তা খুবই মিষ্টি। তবে তা ভীষণ বেদনাদায়ক। কারণ, আমি আমার নিজ চোখের নয়নতারা খাচ্ছি।’ সে তার মাথা তুলে বুজে রাখা চোখটাও দেখালো।

তখন হাতি বললো, ‘যদি খুবই মজার হয়, তবে আমার চোখ থেকে একটা মণি বের করে সেই খাবারের স্বাদ নিতে দাও।’

কচ্ছপ এরই অপেক্ষায় ছিল। হাতিটা কতটা লোভী সে তা জানে। তাই সে সাথে করে একটি ধারালো ছুরিও নিয়ে এসেছে। এবার হাতিকে বললো, ‘আপনি এতই বড় আর উঁচু যে, আমি চোখের কাছে পৌঁছাতে পারছি না।’

হাতি তখন কচ্ছপকে তার শুঁড় দিয়ে মাথার ওপরে উঠিয়ে নিয়ে এলো। কচ্ছপ হাতির চোখের কাছে আসার সাথে সাথে খুব ধারালো ছুরি দিয়ে এক পোঁচে হাতির ডান চোখ বের করে আনল। হাতি ব্যথায় শিহরিত হল। চালাক কচ্ছপ হাতির মুখে শুকনো খৈল আর চিংড়ি পুরে দিলো। দ্রুতই হাতির তালুতে এসব খাবারের স্বাদ পৌঁছে গেল। তাই সে খাবারের স্বাদে মুহূর্তেই সমস্ত ব্যথা ভুলে গেল।

খানিক পরেই হাতিটা বললো, ‘খুব মজার খাবার তো! আমি আরও খেতে চাই।’ হাতির ইচ্ছের কথা শুনে কচ্ছপ বললো, ‘তাহলে তো বাম চোখের মণিও বের করে আনতে হবে।’

লোভী হাতি এবারও রাজি হয়ে গেল।  সুতরাং কচ্ছপ দ্রুত তার চাকু বের করে কাজ শুরু করে দিলো। খুব দ্রুতই সে হাতির বাম চোখ উপড়ে ফেললো। ফলে হাতিটি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেল। কচ্ছপ হাতির মাথা থেকে মাটিতে নেমে নিজেকে আড়াল করে ফেললো। হাতি তখন ভয়ংকর চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। সে সমস্ত গাছপালা শুঁড় দিয়ে টেনে নামাতে শুরু করলো। একের পর এক ক্ষতি করে সে কচ্ছপকে ডাকতে থাকলো। তবে কচ্ছপ কোনও জবাব দেয়নি, এমনকি হাতিও আর তাকে খুঁজে পেল না।

পরের দিন সকালে হাতি পথিকের আনাগোনার শব্দ শুনতে পেল। পাশ দিয়ে যাবার সময় সে এক পথিককে বললো, ‘এখন সময় কতো?’ পাশের ঝোপ থেকে কে যেন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘সূর্য উঠে গেছে। আমি কিছু নাস্তা আর তাজা কচিপাতার খোঁজে বাজারে যাচ্ছি।’

এবার হাতি বুঝতে পারলো, কচ্ছপ তার সাথে প্রতারণা করেছে। কোনো পথচারীকেই দেখতে পাচ্ছিল না সে। তাই তাকে একজোড়া চোখ ধার দিতে যার গলার আওয়াজ কানে এলো, তাকেই অনুরোধ করলো। কিন্তু সবাই তার দাবি নাকচ করে নিজের চোখকে আগলে রাখতে চাইলো। অবশেষে একটা সামান্য কেঁচো চলতি পথে বড় হাতিটিকে দেখতে পেল। সে অত্যন্ত ন¤্রভাবে হাতিকে অভিবাদন জানালো। বনের রাজা তার অভিবাদনে ভীষণ অবাক আর খুব খুশি হল।

হাতি বললো, ‘কেঁচো ভাই, দেখো, আমি আমার চোখ হারিয়েছি। তুমি কি তোমার চোখ দুটো আমাকে কিছু দিনের জন্য ধার দেবে? আমি পরের সপ্তাহে বাজারে এসে ফিরিয়ে দেবো।’

কেঁচো যে হাতির নজরে এসেছে, এতেই সে আহ্লাদে গেল। সে সেই খুশিতে রাজি হয়ে গেল আর তার চোখ বের করে দিলো। সবাই জানে, কেঁচোর চোখ খুবই ছোট। তবুও হাতি কেঁচোর চোখ নিজের বিশাল চোখের কোটরে ঢুকিয়ে দিলো। কেঁচোর চোখ তার নিজের চোখে ঢোকানোর সাথে সাথে চারদিকের মাংস ভীষণ শক্ত হয়ে এঁটে গেল। ফলে পরের হাটে হাতি বাজারে এলেও কেঁচোকে আর চোখ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হলো না। কেঁচো বারবার হাতির কাছে দৃষ্টি ফিরে পেতে অনুরোধ করলো। কিন্তু হাতি তা না শোনার ভান করে রইলো। বরং সে খুব জোরে জোরে বললো, ‘যদি কোনও কীটপতঙ্গ পথে থেকে থাকো, তবে পথ থেকে সরে যাও। আমার চোখ এতই ছোট যে, আমি তোমাদের দেখতে পাচ্ছি না। তাই আমি যদি তোমাদের ওপর দিয়ে পা ফেলে চলাফেরা করি তবে তোমরা চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।’

সেই থেকেই কেঁচোরা চিরতরে অন্ধ হয়ে গেল! একই কারণে হাতিদেরও চোখ হয়ে গেল ভীষণ ছোট। আর যা তাদের বিশাল দেহের তুলনায় খুবই বেমানান।

 

উৎস : নাইজেরিয়ান লোককথা।

লেখক : এলফিনস্টোন ডায়ারেল প্রকাশকাল-১৯১০

প্রকাশক : লংম্যানস, গ্রিন অ্যান্ড কোম্পানি, লন্ডন,