ড. হাসনে আয়মুন »
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ধলই ইউনিয়নে মুশকিল কোশা হাযত রাওযা হযরত শাহজাহান শাহ (র.)-এর অর্ধ সহস্রাব্দ প্রাচীন মাজার শরীফকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ধলই শাহী দরবার শরীফ। ফটির টাকিয়া নামক একদা জনবিরল জঙ্গলাকীর্ণ এই স্থানে এই পবিত্র মাজার শরীফকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অফুরন্ত কল্যাণময়তার এক প্র¯্রবণ। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামে আগমন ঘটে মহান ওলী-আল্লাহ্ হযরত শাহজাহান শাহ’র। তাঁর মূল নিবাস ছিল ইয়েমেনে। এজন্যে তাঁকে হযরত শাহজাহান ইয়েমেনী (র.) নামেও অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশ অঞ্চলে এসে চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা সফর করে তিনি ধলই গ্রামে স্থিত হন। এক নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশে এই মাজার শরীফের অবস্থানকে ঘিরে এক লোকাতীত আবহ বিরাজ করতো। দিনের বেলায়ও বিরাজ করতো সুনসান নীরবতা। রাত্রের বেলায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার খঞ্জনী আর জোনাকির আলোয় থাকতো মুখর। প্রকৃত প্রস্তাবেই মহান রাব্বুল আলামিনের ধ্যান-সাধনার এক প্রাকৃতিক পরিবেশ যেনো।
এবার ২০২১ সনের ২ ফেব্রুয়ারি এই মহান ওলীর ৫১১তম বার্ষিক ওরস শরীফ উদ্যাপিত হচ্ছে। এই ওরস শরীফে অগণিত লোকের সমাগম ঘটে। তাঁরা নিতান্তই সাধারণ মানুষ। দার্শনিক ইবনে সিনা এবং দার্শনিক ইবনে রূশদ ‘ধর্মকে’ সাধারণ মানুষের দর্শন’ (জবষরমরড়হ রং ঃযব চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ঃযব গধংং চবড়ঢ়ষব) বলে অভিহিত করেছেন। বিভিন্ন মাজার শরীফ চড়ান্ত বিশ্লেষণে সাধারণ মানুষের দর্শন চর্চার কেন্দ্রের রূপ লাভ করেছে বললে অত্যুক্তি হয় না। এই দর্শন একাধারে সৃষ্টিতত্ত্ব অন্বেষা এবং মানবতাবাদী সামাজিক পরিবেশ রক্ষার দর্শন। হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (র.), মাইজভা-ার দরবার শরীফ প্রভৃতি আধ্যাত্মিক মহাকেন্দ্রের মতো হযরত শাহজাহান শাহর (র.) মাজার শরীফও অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মানবতাবাদী সামাজিক পরিবেশ রচনার অনুশীলন স্থলে পরিণত হয়েছে। সকল জাত ও ধর্মের মানুষ নিজ নিজ সংস্কৃতি, সংস্কার, ধর্ম বিশ্বাস অক্ষুণœ রেখে পাশাপাশি কাঁধ মিলিয়ে পারস্পরিক কল্যাণের অন্বেষায় এখানে আসেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এক পরম আত্মিক তৃপ্তি নিয়ে কল্যাণ ধারায় স্নাত হন এসব মানুষ। পরস্পরকে ভালোবাসার আবেগে উদ্দীপ্ত হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে উদ্বুদ্ধ হন সকলেই।
সময়ের প্রগতিশীল বিবর্তনের সাথে সাথে হযরত শাহজাহান শাহ (র.) এর মাজার শরীফ কমপ্লেক্সেরও বিবর্তন ঘটছে। এই কমপ্লেক্সের আওতায় বাস্তবায়িত সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে; (১) জামে মসজিদ (২) ফোরকানিয়া মাদ্রাসা (৩) ইবতেদায়ী মাদ্রাসা, (৪) ইসলামী পাঠাগার (৫) এতিমখানা ও হেফজখানা (৬) কমিউনিটি সেন্টার (৭) মার্কেট, (৮) মৎস্য খামার (৯) সবুজ বনায়ন প্রকল্প। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত আয় সেবাধর্মী খাতে ব্যয়িত কিম্বা পুনঃবিনিয়োগ হচ্ছে।
কমপ্লেক্সের আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পও রয়েছে ছয়টি। এগুলো হচ্ছে; (১) হযরত শাহজাহান শাহ মাজার শরীফ পুনঃনির্মাণ প্রকল্প (২) একটি প্রাইভেট মেডিকেল হাসপাতাল স্থাপন (৩) ফ্রি দাতব্য চিকিৎসালয় (৪) কম্পিউটার সেন্টার (৫) যাত্রী ছাউনি (৬) মসজিদ পুনঃনির্মাণ প্রকল্প। জনকল্যাণমূলক এসব প্রতিষ্ঠান-প্রকল্প সর্বস্তরের জনগণের সপ্রশংস সমর্থন ও সহযোগতিা কুড়াচ্ছে।
বর্তমানে হযরত শাহজাহান শাহ (র.) মাজার শরীফ প্রকল্প পুন.নির্মাণের কাজ চলছে। এই মাজার শরীফ প্রায় চারশো বছর সুলতানী আমলে তৈরি ইটের স্মৃতি বহন করেছিল। ১৯৩৯ সন পর্যন্ত তা ছিল চুন-সুরকির ইটের দেওয়াল ও টিনের ছাউনিবিশিষ্ট। ১৯৭৬-৭৭ সনে বর্তমান আকৃতির গুম্বিদবিশিষ্ট করা হয়। এ সময়ে মাজার সংস্কারকালে মঘী হরফের একটি প্রস্তর ফলক পাওয়া যায়। ঐ ফলকের লিপি অনুসারে তাঁর অবস্থান ও জীবনকাল স্থির করা হয়েছে। ২০০৬ সালে তাঁর ৫০০তম ওফাতবার্ষিকী উপলক্ষে মাজার শরীফ আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। বর্তমানে আভ্যন্তরীণ সজ্জা ও ফিনিশিং কাজ চলছে। মাকরানা শ্বেত পাথরের মাজার শরীফের ভিতর ও বাহির সুসজ্জিত করা হবে। বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এই মূল্যবান পাথর আমদানিতে সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছে। এই মেগা-নির্মাণ কাজের পাশাপাশি একটা নতুন অজুখানা, দোতলা অতিথি ভবন এবং কমিউনিটি সেন্টারের তৃতীয়তলা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া দরিদ্র দুঃস্থদের চিকিৎসা খরচ, অভাবী মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিক্ষায় আর্থিক সহযোগিতা দানের কাজও অব্যাহত আছে।
বর্তমান মাজার শরীফ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে তা সারা দেশে অধ্যাত্ম সুষমা বিম-িত নয়নাভিরাম ভক্তি উদ্দীপক স্থাপত্য হিসেবে পরিগণিত হবে। হযরত শাহজাহান শাহ’র (র.) মাজার শরীফ কল্যাণময়তার আগার। নতুন এই নির্মাণ ঐশী কল্যাণময়তার আলোকিত স্থাপত্য হিসেবে সবার ভক্তি-শ্রদ্ধা আকর্ষণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : প্রাবন্ধিক