রুদ্র দাস »
সোনারপুর গ্রামের ছেলেটির নাম রকি। বয়স মাত্র দশ, কিন্তু তার কৌতূহল বয়সের চেয়েও অনেক বড়। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে তার দারুণ ভালো লাগে। বিকেলবেলা দাদু যখন পুকুরপাড়ে বসে থাকেন, তখন রকি ছুটে যায় তার কাছে।
‘দাদু, স্বাধীনতা পাওয়া কি খুব কঠিন ছিল?’
দাদু চোখ বন্ধ করে হাসেন, যেন অনেক দিনের পুরোনো কোনো স্মৃতি তার সামনে ভেসে উঠেছে।
‘স্বাধীনতা পাওয়া সহজ নয়, দাদু। সেটার জন্য অনেক কিছু করতে হয়। তোর জন্য একটা গল্প আছে, শুনবি?’
রকি চোখ বড় বড় করে বলে, ‘নিশ্চয়ই!’
দাদু বলতে শুরু করেন,
‘অনেক অনেক বছর আগে সোনারপুরের গহীন বনে বাস করত এক সোনার হরিণ। সবাই বলত, ওকে ধরার সাধ্য কারো নেই। কেউ কাছে গেলেই মুহূর্তে মিলিয়ে যেত ঘন জঙ্গলের ধোঁয়াশায়। একদিন এক লোভী রাজা শুনল এই হরিণের কথা। সে ভাবল, ওকে ধরে ফেললেই তো তার রাজ্যের ঐশ্বর্য বেড়ে যাবে। তাই সৈন্য পাঠাল ধরার জন্য।
সৈন্যরা ফাঁদ পাতল, লাঠি-তলোয়ার নিয়ে ছুটল, কিন্তু কিছুতেই ধরা গেল না হরিণটাকে। তখন এক সাধু বললেন, ‘এই হরিণ ধরা যাবে না, যতক্ষণ না কেউ ত্যাগের শিক্ষা নেয়।’
রাজা হেসে বলল, ‘এ তো সহজ কথা! আমি তো রাজা, সবাই আমার জন্য প্রাণ দিতে রাজি।’ কিন্তু দিন যেতে থাকল, আর রাজা বুঝতে পারল, হরিণ ধরা শুধু শক্তির ব্যাপার নয়, বরং আত্মত্যাগ আর নিষ্ঠার ব্যাপার।’
রকি গভীর মনোযোগে শুনছিল। গল্প শেষ হতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু দাদু, স্বাধীনতার সঙ্গে এই হরিণের কী সম্পর্ক?’
দাদু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমাদের দেশও একসময় এই সোনার হরিণের মতো ছিল। ব্রিটিশদের শাসন গেল, এলো পাকিস্তানিদের অত্যাচার। তখন মুক্তিযোদ্ধারা বুঝলেন, স্বাধীনতা চাইলে জীবন বাজি রাখতে হবে। তারা যুদ্ধ করলেন, রক্ত দিলেন, অনেকেই শহিদ হলেন। তারপর আমরা পেলাম আমাদের সোনার হরিণ-স্বাধীনতা!’
রকির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে বলল, ‘তাহলে কি স্বাধীনতা হারিয়েও যেতে পারে?’
দাদু একটু গম্ভীর হলেন। ‘হ্যাঁ, দাদু। স্বাধীনতা শুধু যুদ্ধ করে পাওয়া যায় না, এটা ধরে রাখারও দায়িত্ব আছে। যদি আমরা অন্যায়-অসত্যের সঙ্গে আপস করি, যদি দুর্নীতিতে ডুবে যাই, তবে স্বাধীনতা ধরা দিলেও হাত ফসকে চলে যাবে।’
সেই রাতে রকির ঘুম আসছিল না। পরদিন সকালে সে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের বলল, ‘বন্ধুরা, আমরা যদি সৎ না হই, যদি পড়াশোনায় ফাঁকি দিই, যদি কাজ না করি, তবে আমাদের স্বাধীনতা আবার হারিয়ে যেতে পারে! আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে, নইলে স্বাধীনতার সোনার হরিণ আবার হারিয়ে যাবে।’
শিক্ষক মৃদু হেসে বললেন, ‘দেখো, রকি ঠিকই বলেছে! স্বাধীনতা শুধু একটা পতাকা বা দিবস উদযাপন নয়, এটা হলো সততা, পরিশ্রম আর ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা। আমরা সবাই যদি ভালো কাজ করি, তবেই স্বাধীনতার সোনার হরিণ আমাদের সঙ্গে থাকবে।’
রকি সেই দিন দাদুর কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার আলো তার চারপাশে ছড়িয়ে দিল। সে বুঝল, স্বাধীনতা কেবল পাওয়া নয়, সেটাকে ধরে রাখার দায়িত্বও আমাদের সবার। এখন প্রশ্ন হলো তুমিও কি সেই সোনার হরিণকে ধরে রাখতে পারবে?