খন রঞ্জন রায় »
মার্চ আমাদের প্রেরণা ও উদ্দীপনা। ক্যালেন্ডারের পাতায় মার্চ মাস এলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক তিনটি দিনকে স্মরণ করতে হয় অকপটে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাত ও ২৬-এর স্বাধীনতা দিবস। এই সময় বাঙালি আবেগে রুদ্ধ, শক্তিতে বলিয়ান হয়। এ জন্যই মার্চ এক মহাকাব্যের নাম। মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়ার ইতিহাস শুরু এখান থেকেই।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধ্বংস ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে ৯ মাসের মরণপণ লড়াইয়ে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। যতদিন বাংলাদেশ পৃথিবীতে টিকে থাকবে, ততদিন মার্চ মাসের অর্থবহতা বাঙালির চেতনায় থাকবে উজ্জ্বল। এবারের দিন বিশেষ তাৎপর্যের। গুরুত্বের। গর্ব ও অহংকারের। আমরা পার করছি স্বাধীনতার ৫০তম বছর।
স্মৃতিময় এইদিনে দাঁড়িয়ে জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের অর্জন ও সম্ভাবনায় এক কঠিন বাস্তবতার ছবি ভেসে উঠে।
বঙ্গবন্ধুকন্যার অসাধারণ নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতায় স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগেই উন্নয়ন আর অগ্রগতিতে ‘বাংলাদেশ’ এক বিস্ময়ের নাম। একসময় যেসব দেশ বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ দিত, তারাই এখন প্রশংসাবাণে ভাসিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়াকে। নি¤œ আয়ের দেশগুলোকে ছাড়িয়েছে তো অনেক আগেই। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। স্বপ্ন দেখছে দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশের জায়গা করে নেওয়ার। অতি সম্প্রতি ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ’ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০২১’ নামের রিপোর্টে পূর্বাভাস দিয়েছে, “বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, একটি জনবহুল ও নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেভাবে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূর এবং বৈষম্য কমানোকে সংযুক্ত করেছে, তা উল্লেখযোগ্য। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন উদাহরণ। পিছিয়ে পড়া ও অতিদরিদ্রদের জন্য সামাজিক কর্মসূচি খাতে অব্যাহতভাবে বাজেট বাড়িয়ে চলেছে। যেমন বেড়েছে দেশের অর্থনীতির আকার, তেমনি বিস্তৃত হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য। ভারতের পার্লামেন্টে ২০২১ সালের বার্ষিক বাজেটে প্রতিবছরের মতো বিগত আর্থিক বছরের সমীক্ষা রিপার্টে তৈরি করা হয়েছে। দুই খ-ের রির্পোটে বাংলাদেশের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি অধ্যায় লেখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রপ্তানি থেকে যে রাজস্ব আয় করেছে সেটা ভারতের কাছে শিক্ষণীয়। বিগত দশক ধরেই বাংলাদেশ রপ্তানিনীতিতে ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।
গণতন্ত্রের যে তিনটি দিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। সবার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ ও অংশীদারি নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশে রূপকথার অগ্রগতি হয়েছে। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য দেশে মুক্তচিন্তার মতবাদের আধিক্য থাকতে হবে। সহনশীল, অধিকার আদায়ী, সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্রী মনোভাব পরিহারী নাগরিক লাগবে। আরো কিছু সূচকে আমাদের অগ্রগতির মাত্রায় হাত দিতে হবে- বেপরোয়াভাবে সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ, মেয়াদোত্তীর্ণ অনুমোদনহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ। এসব বাহনের ইঞ্জিন বাইরে থেকে আনা পরিহার করে নিজস্ব কারখানা স্থাপন চিন্তা করা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমাদের অবস্থান উল্লাস প্রকাশের মতো নয়। এ সেক্টরে কিছু অর্জন আশাতীত। যেমন প্রাথমিক চিকিৎসা ও টিকাদান কর্মসূচি। এদেশে বিশ্বমানের চিকিৎসক যেমন আছেন, ভুল চিকিৎসা প্রদানের নিদর্শনও ভুরিভুরি। চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত সকল প্রকার সরঞ্জামে বিদেশ থেকে আসে। তুচ্ছ জিনিস জোগানে অপারগ এ সেক্টরকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে প্রযুক্তিনির্ভর করে দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবলের সমন্বয়ে গড়ে তুলতে হবে।
শিল্পের বেলায়ও একই কথা, সেই পুরনো সুর। একটি কারখানার তিনটি স্তম্ভÑ ম্যান, মেশিন ও ম্যাটিরিয়াল। আমাদের কারখানার শতভাগ কলকব্জা বিদেশ থেকে আসে। কাঁচামালের ক্ষেত্রে কৃষিভিত্তিক শিল্পে কিছু কাঁচামালের জোগান দেয়া হয় বটে, অধিকাংশ শিল্পের কাঁচামালই বিদেশ থেকে আনতে হয়। বিশেষ করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান খাত বস্ত্র শিল্পের কাঁচামালের শতভাগই বাইরের। বস্ত্র শিল্পের প্রারম্ভিক ধাপ স্পিনিংয়ের তুলা, যা পুরোটাই আমদানিনির্ভর। কেবল জনশক্তির জোগান দেয়া যাচ্ছে তাও শ্রমিকশ্রেণির। সুষ্ঠুভাবে কারখানা পরিচালনায় দক্ষ শ্রমশক্তি বিদেশনির্ভর।
সবচেয়ে হতাশাজনক চিত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। এ জাতি বই পড়া একরকম ছেড়েই দিয়েছে। কিছুদিন আগেও অবসরের সঙ্গী বলতে গল্প-উপন্যাস-কবিতা ও গানকে বোঝানো হতো। এখন অনেকেই অবসর যাপন করে ইন্টারনেট ব্রাউজ করে। এখন সঙ্গীত শোনা যায় মোবাইলের রিংটোনে। টেলিভিশনেও বিদেশি চ্যানেল প্রীতি। সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, টিভি সবকিছু এখন অন্তঃসারশূন্য। দুদশক আগেও গ্রামের ছেলেমেয়েরা টাকা-পয়সা জমিয়ে সংসার উন্নয়নেÑ পালনের জন্যে হাঁস-মুরাগি কিনত। এখন টাকা হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লেক্সিলোড করে। আগে গৃহিণীরা গোপনে স্বামীর পকেট থেকে টাকা সরিয়ে, অনেক কিছু কিনত। এখন সে টাকায় কেনে মোবাইল সেট, কালার টিডি, রং ফর্সাকারী ক্রিম।
ইউনিসেফের জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬৪ শতাংশ মেয়েরই বিয়ে হয় ১৮ বছরের মধ্যে এবং এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ১৫-১১ বছর বয়সেই অন্তঃসত্ত্বা বা মা হয়, আইসিডিডিআরবির সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, অল্প বয়সী বিবাহিত মেয়েরা স্বামী কর্তৃক অধিক নির্যাতনের শিকার হয়। এ ছাড়া সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন বেড়ে চলেছে ১৫ শতাংশ হারে। মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাবমতে, গত এক বছরে দেশে ৩১৭ জন নারী ও শিশু খুন হয়েছে এবং ৩৯৮ জন নারী নির্যাতিত হয়েছে এবং ৮১ জন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মাহত্যা করেছে। এর মূলে রয়েছে শিক্ষা। কর্ম উপযোগী শিক্ষা, দক্ষতা উত্তরণের শিক্ষা।
দক্ষ বাংলাদেশি কর্মীর অভাব থাকায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বিদেশিদের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট, কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্টাইজিং, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানি, মোবাইল ফোন কোম্পানি, এয়ারলাইন্স, ফার্নিচার কোম্পানি, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, মিডিয়া রিসার্চ প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপনী সংস্থাসহ বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি কাজ করার তথ্য পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি ভারতীয়, এর পরই শ্রীলংকা, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইনসহ আফ্রিকা, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। ৫ জন বাংলাদেশি কর্মকর্তার মোট বেতনের চেয়েও বেশি বেতন ও সুযোগে-সুবিধা পেয়ে থাকেন একজন বিদেশি কর্মকর্তা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় বায়িং হাউস, গার্মেন্ট ব্যবসা করছেন চীনা, ভারতীয় ও বিদেশিরা। নামে-বেনামে স্থানীয় অনেক গার্মেন্ট কারখানার মালিক আছেন বিদেশি নাগরিকরা। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার যে দৈন্যতা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই তৈরি পোশাকখাত।
দেশে প্রাথমিক টেক্সটাইল খাতে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করলেও প্রায় ২০ শতাংশ শ্রমিকের ঘাটতি আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন। ‘দেশে প্রচুর কর্মক্ষম লোক আছে, বেকার আছে; কিন্তু দক্ষ লোক একজনও বেকার নেই। দক্ষতার সংকট সর্বত্র, সবখানে। পরিবহন খাতের অবস্থাতো আরো নাজুক, জনপ্রতি যানবাহনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। গাড়ি কম, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বৈশ্বিক সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানানো হয়েছে। দেশে শিক্ষা-প্রশিক্ষণবিহীন চালকের বেপরোয়া মনোভাব, ত্রুটিপূর্ণ যান ও সড়ক, দুর্ঘটনা-পরবর্তী সেবার অপ্রতুলতা, সচেতনতার ঘাটতি ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি।
এই সমস্ত মনুষ্যসৃষ্ট বিষয় সমাধান নিয়ে সরকার, রাজনীতিবিদ বা সমাজপতিদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। দেশের তরুণ সমাজকে এইসব কাজে সম্পৃক্ত করাতে হবে। নতুন প্রজন্ম দেশ গঠনে যত বেশি ভূমিকা রাখবে, দেশ তত দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাবে। ১৯৭১ সাল এবং মার্চ মাস বাঙালি যেভাবে প্রমাণ করেছে তারা যুদ্ধ করে মুক্তি আনতে জানে, তেমনি নতুন প্রজন্মকে সুযোগ করে দিতে হবে যেন তারা দেশপ্রেম, মেধা, দক্ষতা ও আত্মশক্তি দিয়ে বিশ্বের বুকে আধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মর্যাদাশীল, সামাজিক ন্যায় ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যয় ছিল তার যেন শতভাগ বাস্তবায়ন হয়।
আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণদের সম্ভাবনা, দক্ষতা, সৃজনশীলতা পাকাপোক্ত করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এইজন্য দরকার শিক্ষা। একুশ শতকে শিক্ষার ধরণ আরো বদলে গেছে। যে শিক্ষা দিয়ে আমরা গরিবকে ধনী হতে দেখেছি, যে শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে আমরা গর্বিত হয়েছি, যে শিক্ষার দীক্ষা মার্চের অঙ্গীকার হতে শেখায়, যে শিক্ষা নিজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে আমাদের শিক্ষার বীজমন্ত্রে। নিজস্ব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি সহযোগে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। গতানুগতিকতা থেকে বেড়িয়ে পড়ার শিক্ষা। যেটি মার্চ আমাদের দেখিয়েছে।
লেখক : গবেষক ও সংগঠক
শযধহধৎধহলধহৎড়ু@মসধরষ.পড়স