স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : তরুণদের হাতে তুলে দিতে হবে আত্মপরিচয়ের গৌরবগাথা

খন রঞ্জন রায় »

এবারের মার্চ বিশেষ মার্চ। ২৬ শে মার্চ। আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। গৌরবদীপ্ত ও দুর্বিনীত সাহসী জাতি হিসেবে দিনটি অনন্যসাধারণ ও স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যম-িত। এ দিনটি শুধু পঞ্জিকার পাতায় কোনো জ্বলজ্বলে লাল তারিখ নয়, নয় কেবল চৈত্রের দগদগে রৌদ্রময় একটি দিন, বাঙালি জাতির কিংবদন্তীতুল্য দেশপ্রেম, অবিরাম সংগ্রাম এবং সংহত শক্তিরও প্রতীক। আলোকোজ্জ্বল এ দিনটি আমাদের সামগ্রিক জীবন, ইতিহাস এবং এর সত্তা ও স্বরূপকে গৌরবান্বিত করেছে।
আমাদের জাতির আত্মপরিচয় অর্জনের দিন, পরাধীনতার শিকল ভাঙার দিন। দিনটি আবেগমথিত, মহিমান্বিত ও অনন্যচেতনায় ভাস্বর। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক ক্ষণ এটি। লক্ষ জনতার আপসহীন মনোভাব ও বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতিসত্তায় বিশ্ববুকে অধিষ্ঠিত। ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ সংগ্রাম অতিক্রম শেষে একাত্তরের মার্চ ছিল আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বাঁক বদলের মাস। উত্তাল মার্চের ২৬ তারিখ। আমাদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ঘোষণার প্রতীক্ষায় যুগ যুগ ধরে অপেক্ষায় ছিল দেশের মানুষ। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির জন্য পরম আকাক্সক্ষার বিষয়। আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সুশাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যের অবসান ইত্যাদি ছিল স্বাধীনতার লক্ষ্য। এইসব লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশা নিয়েই জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং বিপুল ত্যাগ ও মূল্যে স্বাধীনতাকে স্বপ্নের বন্দরে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই জাতির কর্তব্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের বীজটিও রোপিত হয়েছে সেদিন থেকে।
জাতীয়তাবাদী জাতিসত্তার কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়। দাসত্ব শৃঙ্খল আজি কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।’ ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে বাঙালির স্বাধিকার চেতনায় অনুরূপ উচ্চারণ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রাম, বিক্ষোভ-বিদ্রোহ, অসহযোগ- সংঘটিত হতে থাকে। অতঃপর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়। স্বাধীনতা একটা জাতিগোষ্ঠীর মৌলিক স্বত্ব অধিকারের চাওয়া-পাওয়া। নিজের মতো করে নিজের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। ধর্ম-কর্ম,, শিক্ষা-দীক্ষা, অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান-চিকিৎসা ইত্যাদি ব্যাপারে একটা অবাধ স্বতঃস্ফূর্ততা অর্জন করা । স্বাধীনতা শব্দটির তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। স্বাধীনতা মানে কেবল নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন নয়। স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার আয়োজন। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি, শোষণমুক্ত সমাজ, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী মুক্তি আন্দোলন, নারী শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি।
২০২১ সালের স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের উন্নয়নের উজ্জ্বল কিছু রং দেখছি, যা আমাদের কৃষক, শ্রমিক ও সংগ্রামী নারীরা, অবহেলিত তরুণেরা কষ্টের এবং পরিশ্রমের তুলিতে লাগিয়েছেন। বিপরীতে কিছু বৈষম্য, এই বৈষম্য ধনী-গরিবের, গ্রাম-শহরের, মালিক-শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান পার্থক্যের। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁরা চোখে যে স্বপ্নটা নিয়ে গেছেন, তা ছিল সাম্য-মর্যাদা-সুবিচারের, এক আদর্শিক সোনার বাংলার।
জাতি আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মবার্ষিকী স্মরণে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন গৌরবের। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি নিয়ে দেশিÑবিদেশি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদগণ প্রশংসা করেছেন। মুজিববর্ষ ও সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে প্রতিবেশি দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, রাজনীতিবিদগণÑএই উপলক্ষে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এই বছরই জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘের তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি’ অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের বিপুল কর্মযজ্ঞে এখন বাংলাদেশ। নারী জাগরণ এবং নারী ক্ষমতায়নের পর্বে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দৃষ্টান্তস্বরূপ। করোনাকাল আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেললেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারে প্রচেষ্টা জাতিসংঘ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রশংসা পেয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেকগুলি মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে যা আগামী দিনের অর্থনীতিতে শক্ত ভিত প্রদান করবে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি আমাদের জাতীয় সক্ষমতার পরিচয় বহন করে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা শুরু হয়েছে ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উত্তরণের স্বপ্ন দেখছে জাতি। আর এই বিপুল ও বহুমুখি কর্মপ্রবাহে বেগ সৃষ্টি করবে আজকের তরুণরা। এ জন্য তাদের হাতেই স্বাধীনতা ও যাবতীয় গৌরব অর্জনের পতাকা তুলে দিতে হবে। আমাদের আগামী কর্মক্ষম তরুণরাই দেশকে গড়ে তুলবে। এ জন্য তাদের প্রস্তুত করাই হবে জাতীয় কর্তব্য।
শিক্ষা জনগণের ক্ষমতায়নের একটি উপায়, এর মাধ্যমে তরুণরা তাদের আচরণ ও দক্ষতাকে সমন্বিত করতে পারে, ফলে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে মর্যাদা ও সমতা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। অধিকার সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হয়ে শ্রদ্ধাশীল হয়। দেশপ্রেমী হতে উদ্বুদ্ধ করে। আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। এইজন্যই তরুণ যুব গোষ্ঠীর দরকার প্রাতিষ্ঠানিক প্রযুক্তি শিক্ষা। তবেই বাংলাদেশ রূপান্তরের মহাসড়কে বেগবান ও শক্তিশালী হবে। দক্ষ মানবসম্পদ দক্ষ বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। তরুণদের একুশ শতক ও বিশ্বায়ন উপযোগী করে প্রস্তুত করতে পারলে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ, ২০৩০ এর শতবর্ষীয় সম্ভাবনার টেকসই উন্নয়নের বাংলাদেশ এবং ২০৪১-এ উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার চিন্তা সহজ হবে। সফল হবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময়ে করোনাকালীন বিধ্বস্ত ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতার মর্মবাণীই পুনরুচ্চারণ করতে হবে। স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তি নয়। স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে মাথা তুলে থাকার সব আয়োজন। এই আয়োজনের ভার তুলে দিতে হবে আমাদের তরুণদের কাঁধে। তৈরি করতে হবে এই ভার বহনের সক্ষম, শক্তিশালী মানবিক মানুষ হিসাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুঞ্জয়ী স্মৃতি প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও লক্ষ লক্ষ্য দেশবাসীকে যাদের আত্মদান আমাদের স্বাধীনতার অরুণ আলোয় উদভাসিত করেছে।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক