স্বপ্নের বসতবাটী ও অন্তর্লীন চাষ আবাদ

প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতিটাই আলাদা। অনেকে সেটি প্রথম সন্তানলাভের আনন্দানুভূতির সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। এ সংখ্যা থেকে শিল্পসাহিত্যে ধারাবাহিকভাবে লেখকদের প্রথম বই নিয়ে স্মৃতিচারণা প্রকাশিত হবে।

স্বপন দত্ত »

স্বপ্নের বসতবাটী গড়ে তোলার জন্যে যেরূপ অন্তর্লীন চাষ আবাদ করা প্রয়োজন ছিলো তা শুরু করেছিলাম ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকটায়। তখন পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের জুলুমশাহী মসনদ ভেঙে পড়েছে। আরেক স্বৈরশাসক উর্দিপরা ইয়াহিয়া খানের শাসনকালও কাঁপছে ঊনসত্তরের পূর্ব পাকিস্তান কাঁপানো সেই গণ-অভ্যুত্থানের ঝড়ে।
স্বপ্নের বসতবাটী ও অন্তর্লীন চাষ আবাদ। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে সম্পাদক প্রকাশনী থেকে। চট্টগ্রামের সদরঘাট কালীবাড়ির মোড়ে, খ্যাতিমান হয়ে উঠতে থাকা ঘুপচি গলির ভেতরের ‘চেম্বার প্রেস’ তখন আমাদের ঠিকানা। সদা হাস্যমুখ ছাখাওয়াৎ উল্লাহ ইউনুছ ভাই এ প্রেসের সত্ত্বাধিকারী হলেও কম্পোজিটর অঞ্জন ও মেশিনচালক শফিভাইকে নিয়ে আমরা প্রেসটি প্রায় দখলে নিয়েছিলাম। এর উস্কানিদাতা ছিলো আমাদেরই বন্ধু ইউনুছ ভাইয়ের আত্মীয় প্রেস-ব্যবস্থাপক শহীদুল হক। সম্পাদক প্রকাশনীর যৌথ প্রকাশক ছিলো শহীদুল হক ও শিশির দত্ত। এ প্রকাশনার যাবতীয় বিষয় সম্পাদনা ও ভুল সংশোধনসহ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আবসার ও আমি স্বপন দত্ত নির্ণয় করে দিতাম। সম্পাদক প্রকাশনীর যাবতীয় প্রকাশনার কাজ আমাদেরই অনুমোদন সাপেক্ষেই হয়েছে।
এ দক্ষতাটুকু অর্জন করেছিলাম ১৯৬৯-৭০ সালের গোপন প্রকাশনার কাজ বিভিন্ন প্রেসে ঘুরে ঘুরে করতে গিয়ে। সেই সময়ের রাজনৈতিক ঝঞ্ঝার কালপ্রবাহ সবার চিন্তা-চেতনার বিভেদকে মিলিয়ে-মিশিয়ে করে একাকার ও একমুখী। অতঃপর সব নদীর ধারাকে আপন আপন গতিবেগে বঙ্গোপসাগরমুখী স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। পূর্ববাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) সর্বাত্মমুখী গণবিপ্লবের জোয়ারে গোপন রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ আদর্শভিত্তিক আস্থা আর বিশ্বাসের দরোজা-জানালাগুলো ক্রমে চুরমার হয়ে যেতে থাকলে, আমরা তারুণ্যের দলগুলোও ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হয়ে পড়ি। স্বাধীনতার ঘ্রাণ আমাদেরকে বাস্তবতা উপলব্ধির বেহুলাভেলায় আত্ম-অনুসন্ধান করতে বলে। আমরা তখনই পেতে শুরু করি বিকাশমান কুসুমের স্বপ্ন সৌরভ। আমরা তারুণ্যের ঘোড় সওয়ারের একটা বিশাল দল বলতে থাকি -একটি বুলেট এনে দিতে পারে মানুষের স্বাধীনতা- (সুনীল নাথ)। শ্রেণীশত্রু খতমের ভ্রান্ত নীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটি বড়ো যুবশক্তি তখন দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ও আর্থ-সামাজিক পথের সন্ধানী হয়ে উঠতে থাকি।
স্বপ্নের বসতবাটী ও অন্তর্লীন চাষ আবাদ” কবিতার বইটির কবিতাগুলো মলাটবদ্ধ হয়ে প্রকাশ পাওয়ায় আমি সেই ১৯৮০ সালের স্বাধীনতা দিবস থেকে এখনও অবধি শিহরণ অনুভব করি। এই বইয়েই লিখেছি এদেশের প্রেমে ও ভালোবাসায়, অশোকা দু’জনার ছিলে,/ কখনও ভেবেছো নাকি/ বেশী ছিলে কার? আরও লিখেছি, কাছে এলে বড়ো কষ্ট,/ দূরে গেলে আরও কষ্ট পাই।” আবার বলেছি, চন্দনের ঘ্রাণ বুকে/ তাই, সে মেয়েকে আমি/ চন্দনাই ডাকি।” আরো খানিকটা এগিয়ে বলেছি, তুমি বললে,/ না ছুঁয়ো না, না ছুঁয়ো না,/ পাপ। তোমার কিছুই ছুঁতে পারি না, / কেমন অভিশাপ!
এ বই প্রকাশের আনন্দ এমনই যে, মনে হয়, যেনো এক পাথর প্রাণ পেয়ে প্রবাহিত ধারায় মুক্ত হলো। প্রমিথিউসের আগুন আনা, মানুষের জন্যে, তাও বুঝি এমনই পরম আনন্দের। সেকালে স্বপ্নের বসতবাটী ও অন্তর্লীন চাষ আবাদ” কাব্যগ্রন্থটির মূল্য ছিলো ছয় টাকা। এ বইয়ের প্রচ্ছদ কবি-শিল্পী খালিদ আহসানের। সবশেষে উল্লেখ করি, এ কাব্যগ্রন্থের জন্যে সে বছর খালিদ আহসান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রথম পুরস্কারটি পায়। পুরস্কার কমিটির সদস্য ছিলেন কয়েকজন বিদেশী চারুশিল্পী।
প্রথাগত ধারার বাইরে গিয়ে প্রথম পুরস্কার রাজধানীর বাইরের শিল্পীর কাছে চলে যাওয়ায় সেবার রাজধানীর দৈনিক পত্র-পত্রিকায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পুরস্কারের সংবাদটি প্রকাশ করা হয়নি। কয়েক বছর পরে এটি জানাজানি হলে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার তৎকালীন রিপোর্টার প্রদীপ খাস্তগীরের সহায়তায় খালিদ আহসান অর্থমূল্যসহ চা-নাস্তা সহযোগে পুরস্কারটিকে সমাধিস্থ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে।
প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের অভিজ্ঞতা যে কতোই-না বিচিত্র হতে পারে!