‘আঁটসাঁট’ মুদ্রানীতিতে বাড়ল রেপো হার
সুপ্রভাত ডেস্ক
মূল্যস্ফীতির চাপ আর অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা সামাল দিতে বাজারে অর্থের জোগান আরও কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; এর অংশ হিসেবে নীতি সুদহার আরও এক দফা বাড়িয়ে এবং আইএমএফ এর পরামর্শে সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ‘সঙ্কুলানমুখী ও আঁটসাঁট’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
ব্যাংক ঋণের সুদহারে এতদিনের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দিয়ে ‘রেফারেন্স রেট’ অনুযায়ী সুদ হার নির্ধারণের নতুন নিয়ম চালু হচ্ছে।
এসএমএআরটি (স্মার্ট-সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ) নামের এ পদ্ধতিতে ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে রেফারেন্স। এরসঙ্গে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করে এবং ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে।
কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাত ও ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ সামাল দিতে আরো ১ শতাংশ যোগ করতে পারবে সুদ হারে।
আর এক দিন মেয়াদী রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদ হার ৬ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। রিভার্স রেপো হার (জুলাই থেকে এসডিএফ নামে পরিচিতি হবে) আগের ৪ দশমিক ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।
রেপো ও রিভার্স রেপোর এই নতুন হার ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।
এর আগে গত জানুয়ারির মুদ্রানীতিতে রেপোর সুদ হার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর রিভার্স রেপো হার আগের ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে এক অনুষ্ঠানে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের এই মুদ্রানীতি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমরা সরবরাহ সাইড ঠিক রেখে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছি, যাতে সরকারি ঋণেও অর্থ খরচ বাড়ে। টাকার সরবরাহ কমিয়ে এনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই উদ্দেশ্য।’
এবারের ষান্মাসিক মুদ্রানীতিকে ‘কন্ট্রাকশনারি ও টাইট’ ভঙ্গির মুদ্রানীতি হিসেবে বর্ণনা করেন গভর্নর।
গত বছরই আইএমএফ এর কাছ থেকে সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ আসে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করার আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি চালু করারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও তার বাজেটে বলেছিলেন, মুদ্রানীতির কাঠামোতে অধিকতর স্বচ্ছতা ও নমনীয়তা আনতে এবং মুদ্রার চাহিদা ও সরবরাহকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা বিবেচনায় ‘মনিটরি টার্গেটিং’ এর স্থলে ‘ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিং’ এর দিকে সরে আসার চিন্তা করা হচ্ছে।
মুদ্রানীতি ঘোষণার অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব ‘দুই পদ্ধতিতেই’ করবে। অর্থাৎ, আগে যে পদ্ধতিতে করা হত, সেভাবেও করা হবে, আবার বিপিএম৬ পদ্ধতিতেও করা হবে।
‘তরে আমরা বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য হিসাব করলেও তা প্রকাশ করব না। পৃথিবীর কোনো দেশ তা প্রকাশ করে না। আইএমএফ এর এ বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই প্রকাশে।’
সরকারের বাজেট বাস্তবায়নকে সহায়তা করে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি সময়ে বাজারে কি পরিমাণ অর্থের প্রবাহ থাকবে তা নির্ধারণ করা হয়ে মুদ্রানীতির মাধ্যমে।
তাতে নীতি সুদহারকে নিয়ন্ত্রণ করে বাজেটে ঠিক করা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখতে আর্থিক পরিবেশের কৌশল ঠিক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন নীতি সুদ হার।
ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট।
রেপো রেট বৃদ্ধি করায় ব্যাংকগুলোর অর্থ নেওয়ার খরচ বাড়বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে।
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪৩ শতাংশ, গত মুদ্রানীতিতে যা ছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০.৯ শতাংশ, গতবার ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬.৯ শতাংশ, গতবার যা ধরা হয়েছিল ১৬.৯ শতাংশ,
মুদ্রানীতির যে প্রক্ষেপণ চলতি জুন মাস শেষে অভ্যন্তরীণভাবে ধরেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তার কতটা অর্জন হয়েছে, সে তথ্যও জানানো হয় মুদ্রানীতির অনুষ্ঠানে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হলেও মে মাস শেষে অর্জন হয়েছে ৪৩.৩ শতাংশ।
আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ, হয়েছে ১১.১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৮.৫ শতাংশ, আর গত মে পর্যন্ত হয়েছে ১৬.৭ শতাংশ।
জাতীয় বাজেটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা নির্ধারণ করছে সরকার।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভনর আহমেদ জামালসহ, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক ও অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।