সুকুমার বড়ুয়া : ছন্দে ও সমাজের অবয়বে

একুশে পদকপ্রাপ্ত ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

ওমর কায়সার »

সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার তীব্র শ্লেষ বা ব্যঙ্গোক্তি। অসংগতি, বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার যা দেখেছেন তাই তুলে ধরেছেন সহজ ভাষায়, স্বতস্ফুর্ত ছন্দে। তাঁর স্বরবৃত্তের পাগলা ঘোড়া লাফিয়ে কিংবা দৌড়ে মানুষের অন্তরের গহীনে গিয়ে ধাক্কা দেয়। বিবেকে কশাঘাত করে। তাঁর শব্দগুচ্ছ ছেলেখেলার ছদ্মাবরণে শেষপর্যন্ত সময়ের গতিকেই চিহ্নিত করে। বাংলাদেশে বহুল পঠিত, বহুল চর্চিত, বহুল পরিচিত সুকুমার বড়ুয়ার বেশ কিছু ছড়া ছোটবড় অনেককে মুখস্ত আবৃত্তি করতে শুনি। অনেকে ছড়া আবৃত্তি করেন, কিন্তু তার রচয়িতার নাম জানেন না। রচনা যদি রচয়িতার চেয়ে বড় হয়ে যায়, তখন আর কেউ রচয়িতার খবর রাখে না। সুকুমার বড়ুয়ার লেখা মাঝে মাঝে তার চেয়েও বেশি পরিচিত। তার লেখা ছোটরা মনে রাখে ছন্দের মায়ায়। বড়রা আবৃত্তি করেন কথার ধারের জন্য। নাটকীয়তার মাধ্যমে ধারালো কথায় তিনি তীব্র কটাক্ষ কিংবা কোনো গুরুতর বিষয়ে ইংগিত করেন বড়দের জন্য। অথচ সেগুলো রচিত হয়েছে ছোটদের জন্য। সেই জন্য শিশু বয়সে যে শিশু ছন্দে ছন্দে মনের আনন্দে সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া আবৃত্তি করেন, সে শিশু বড় হয়ে সেই ছড়ার মধ্যে সমাজের অবয়ব দেখতে পান। সুকুমার বড়ুয়া এভাবেই ছেলে বুড়ো সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন। তার ‘ঠিক আছে’ছড়াটি এখন আমরা পাঠ করতে পারি।

অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে ।
রেশনের পচা চাল
টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙা-চোরা
বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে ঠিক আছে ।
মেঘ দেখে মেহমান
চাইলেন ছাতাখান
দেখালাম ছাতাটার
শুধু কটা শিক আছে
তবু তিনি বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে ।
(ঠিক আছে)
বাংলাভাষার জনপ্রিয় প্রথম চার পাঁচটা ছড়ার মধ্যে এটি একটি। এটি সুকুমার বড়ুয়ার সিগনেচার ছড়াও বলা যায়। একজনের তীব্র অসহায়ত্ব প্রত্যক্ষ করেও অন্যজন কী আশ্চর্য নির্বিকার! এই ছড়ার দুর্দান্ত নাটকীয়তা, দুজনের কথোপকথনের মধ্যে হাস্যরসের উপাদান থাকলেও শেষ পর্যন্ত সমাজের এক আশ্চর্য চরিত্রকেই কটাক্ষ করেছেন। সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ার যে গুনগুলোর কথা সাধারণত বলা হয় তার সবকিছুই এই ছড়ার মধ্যে বিদ্যমান। ছন্দের ঝংকার, হাসির উপাদান, নাটকীয়তা, অন্ত্যমিলের অভিনবত্ব, শ্লেষ, ব্যঙ্গ, কটাক্ষ সর্বোপরী সমাজচিত্র। একটা ছড়ার মধ্যে এত সবকিছুর উপস্থিতি বাংলা ছড়ায় খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না।
সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ার বৈশিষ্ট্য খুঁজতে এবার পড়ব ‘রাজার ছড়া’। এতে একটা গল্প আছে। হাসি নেই। তবে গোপনে দুঃখ আছে। আছে সামন্ত প্রভু কিংবা রাষ্ট্র নায়কের নিপীড়নের ইংগিত। এই ছড়ায় আমরা দেখতে পাই, রাজা বাজার করতে গেছেন। বিক্রেতারা সবাই খুশি। রাজা তাদের পণ্য কিনবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হলো।

কিনেন বটে মূল্যবিনা
রাজ দর্শন কঠিন কিনা?
এক নিমেষে শুন্য দোকান
খাবার–তেলে ভাজার
রাজার হাতের পরশ পেয়ে
শূন্য হলো বাজার।
(রাজার ছড়া)

শেষ পর্যন্ত রাজার এই বাজার করা আসলে গরীবের ধন লুট করার গল্প। রূপকথার ছলে তিনি এঁকে গেলেন সামন্তসমাজচিত্র।
ছড়ায় সময় ও সমাজকে চিত্রিত করতে অনেক প্রতীকী চরিত্র প্রণয়ন করেছেন তিনি। বাহ্যিকভাবে শিশুতোষ হলেও অন্তর্গত ভাবের দিকটা বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে ভয়াবহ কোনো চরিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

সবুজ বনের তোতা
খাঁচার ভেতর বন্দি হয়ে
ঠোঁট করেছে ভোঁতা
দেখালে দেখে
শেখালে শেখে
শোনালে হবে শ্রোত্
াএর কথা ওর কানে দিয়ে
গণ্ডগোলের হোতা
সবুজ মনের তোতা
(তোতা)
গণ্ডগলোর হোতা শব্দটি চোখের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই শিশুতোষ ছড়াটি সাধারণত্বের গণ্ডি পেরিযে এক অসাধারণ মাত্রায় চলে যায। এইভাবে সমাজ, দেশ, মানুষ সবকিছুই তার ছন্দের জালে ধরা পড়েছে। তিনি ধরেছেন সমাজের খুঁত, মানুষের ভুল, রাজনীতির ফাঁকি, অসাধু ব্যবসায়ীর মিথ্যে বুলি। তিনি লিখেছেন

এক পুতুলের কদর দেখে
আরেক পুতুল জ্বলে
বাঁয়ে যাবার চাবি দিলে
ডান দিকে যায় চলে।
এমন হলো কেমন করে
ভাবছে খুকু তাই
পুতুলগুলোর মাথার ভেতর
মগজ কেন নাই?
(পুতুল)

ছড়াকারের এই প্রশ্ন মানুষের ভেতর অনুরণিত হয়। আসলেই দু’পায়ের জীবন্ত পুতুলগুলোর মাথায় মগজ কেন নেই?

এরকম বহু প্রশ্ন তিনি খুদে পাঠকের মনে প্রোথিত করে দিয়েছেন। যা তাকে ভাবিয়ে তুলবে, যা তাদের বিবেককে শাণিত করবে। একটা শান্তিময় পৃথিবীর জন্য হয়তো সে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

লজ্জা পেল অগ্নিগিরি
টর্নেডো–ঝড়ুজলোচ্ছ্বাস
সভ্য মানুষ করত পারে
কেমন মহা সর্বনাশ!
অ্যাটম বোমার মারণ থাবা
এমন ভয়াল যায়নি ভাবা
হাজার যুগের স্বপ্নে গড়া
সভ্যতাকে করল গ্রাস
হিরোশিমার সেই ঘটনা
ভাবতেও হই রুদ্ধশ্বাস।
(হিরোশিমা)

তবে সুকুমার বডুয়ার ছড়ার মধ্যে শুধু ব্যঙ্গ্বিদ্রুপই প্রধান উপজীব্য নয়। ধারালো কথার তীরে সমাজের নানা অসংগতিকে আঘাত করেছেন ঠিকই। কিন্তু এটিই শেষ কথা নয়। তার ছড়ার পটভূমি আরও বহু বিস্তৃত ও ব্যাপক। সাধারণ গার্হস্থ্য বিষয় আশয়, রূপকথা থেকে শুরু করে হেন কোনো বিষয় নেই তিনি স্পর্শ করেন নি। ছোট্ট গ্রামের ছোট খাল পেরিয়ে নদী, নদী পেরিয়ে সাগর, সাগর পেরিয়ে যেমন মহাসাগরের বিস্তার দেখি তেমনি বিশাল তার ছড়ার পরিধি।

খুব ছোটবেলা থেকে তিনি ছন্দ নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন। এখন তিনি অশিতীপর। দীর্ঘ বিচিত্র বর্ণিল জীবনে বহু বাঁক পেরিয়ে তিনি এতদূর পর্যন্ত এসেছেন। জীবনকে দেখেছেন নানা তিক্ততার ভেতর, নানা যন্ত্রণার ভেতর উপলব্দি করেছেন । ব্রিটিশ উপনিবেশ, পাকিস্তানী শোষনের আমল, বাংলাদেশের অভ্যূদয় দেখেছেন। বহু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন। বিচিত্র জীবন প্রত্যক্ষ করেছেন। এই ব্যাপক অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তার ছন্দের পৃথিবীতে। লিখেছেন অগুনতি ছড়া।

বলতে পার কোন বিচারক
বিচার করে নির্দোষকে
দিচ্ছে ফাঁসি?
কোন সে চালাক ছলের জোরে
নিচ্ছে কেড়ে ফোটা ফুলের
মিষ্টি হাসি?
বলতে পার কাদের ছেলে
রাস্তা থেকে ধুলোয় মাখা
খাবার কুড়োয়?
কাদের ছেলে কুকুর নিয়ে
করছে খেলা সাত মহলা
বাড়ির চুড়োয়?
(বলতে পার)

কবিতার ইশারার মতোই এই ছড়ার আবেদন। শেষের প্যারায় আয়নার মতো প্রতিবিম্বিত হলো আমাদের চিরকালের সমাজবাস্তবতা।
নিম্নমধ্যবিত্ত পর্যায়ে পারিবারিক অবস্থানে থেকে জীবনকে দেখেছেন। ওখান থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন যুগে যুগে মানুষের ভেদাভেদ, বৈষম্য। সেগুলোই তিনি লিখেছেন। দীর্ঘ জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঐতিহাসিক ঘটনা যেমন উঠে এসেছে তার ছড়ায়, তেমনি দেশ, শিক্ষা, প্রকৃতির নানা বিষয় তার ছড়ার মধ্যে উঠে এসেছে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক সাতই মার্চ, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থাণসহ, ইতিহাসের নানা গৌরবময় ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি তার ছড়ায়। ছড়াগুলো যদি আমরা কালক্রমানুসার সাজাই তাহলে বাংলাদেশের ধারাবাহিক ইতিহাসের একটা ছান্দিক দলিল আমরা খুঁজে পাব।
বাহান্নতে বীজ বুনেছে
একাত্তরে দেখ রে আজ
বাংলাদেশের নতুন গাছে
ফুলে ফুলে নতুন সাজ।
ভায়ের মুখোশ লাগিয়ে এলো
সাগর পারের ডাকাত দল
মিষ্টি কথা মন ভুলিয়ে
বানিয়েছিল শোষণ–কল।
দু–যুগ ধরে যায় চালিয়ে
শাসন শোষণ নির্যাতন,
তাই জেগেছে সাত কোটি প্রাণ
করতে লড়াই জীবন পণ।
বাহান্নতে বীজ বুনেছে
একাত্তরে দেখ রে আজ
অত্যাচারের মাথায় পড়ে
সর্বনাশা মৃত্যু–বাজ
বিশ্বে লাগে বিরাট কাঁপন
শূন্য হাতেই শত্রু শেষ
মুক্তিসেনার রক্তে ডুবে
মুক্ত সোনার বাংলাদেশ।
(সাফল্য)

কয়েকটি পংক্তির মধ্যেই বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জ্বলজ্বল করছে। এরকম একটা দুটো নয়, বাংলা, বাঙালি, বাঙালির জীবন যাপন, সংগ্রাম উঠে এসেছে এরকম বহু কালোত্তীর্ণ ছড়ার উদাহরণ আমার পাই তার সৃষ্টির মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ছড়ার মধ্যে আরেকটি ছড়ার সামান্য অংশ এখানে তুলে ধরছি।

ধন্য সবাই ধন্য
অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করে
মাতৃভূমির জন্য।
ধরল যারা জীবনবাজি
হলেন যারা শহিদ–গাজি
লোভের টানে হয়নি যারা
ভিনদেশিদের পণ্য।
(মুক্তিসেনা)

এভাবেই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক তার ছড়ায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। তারই ধারাবাহিকতায় অনিবার্য ভাবে উঠে এসেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। বঙ্গবন্ধু জীবনের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি ছড়া লিখেছেন। বলতে গেলে তিন তার জীবনচিত্র এঁকেছেন ছড়ায় ছড়ায়। একটি ছোট উদাহরণ টানছি

রমনা–মাঠের গণ্ডি ফেলে
গঞ্জে–ঘাটে আগুন জ্বেলে
সাগর–পাহাড় তুচ্ছ করে
বিশ্ববাসীর ঘরে ঘরে
নির্যাতিত যেখানে
কণ্ঠ বাজে সেখানে
রক্ত দিলামÍ রক্ত দেব
মুক্তি আমার ছিনিয়ে নেব’
(সাতই মার্চ)

সুকুমার বড়ুয়ার প্রকৃতি এসেছে একেবারে জলছবির মতো।

নদী চলে ঢেউ তুলে ভাসিয়ে দুকূল
ভোর হলে পাখি সব খুশিতে আকুল
মায়াভরা এই দেশে
হেসে–খেলে ভালোবেসে
দিনগুলো ভরে যায সুরেতে মধুর।

সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ার বিষয় বৈচিত্রে ভরা। নানা রঙে সমাহার সেখানে। বস্তু জগতের কাঠিন্যকে যেমন তিনি তুলে ধরেছেন, তেমনি কল্পনার বিস্তার ঘটিয়ে শিশুমনে স্বপ্ন রচনাও তিনি করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি চিরস্থায়ী একটি রঙিন পৃথিবী তৈরি করে গেছেন। যে পৃথিবী শিশুমনে একটি দীর্ঘ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, শিশুর মনে স্থায়ী একটি ছাপ ফেলে। তাঁর ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য স্বতস্ফুর্ততা। সহজ ভাষা, সরল অভিব্যক্তি তার ছড়ার প্রাণ। এগুলোর মূল পাঠক শিশু। এ কথা মনে রেখেই জটিল বাক্য, তৎসম ও যুক্তাক্ষর যথাসম্ভব তিনি সবসময় এড়িয়ে গেছেন। মাত্র কয়েকটা সহজ সরল পংক্তি দিয়ে তিনি অদ্ভুত একট দোলা দিতে পারেন। ছন্দের দোলায় তিনি চরিত্র সৃষ্টিতে অনবদ্য। সেসব চরিত্রের আচরণ অদ্ভুত। শিশুদের মনে কৌতুহলের সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত চরিত্রটির আচরণ, কিংবা স্বভাব শিশুকে নির্মল আনন্দ দেয়।

টেংরা মাছের মেয়ের বিয়ে
গান জুড়েছে বাতাশি
হঠাৎ করে গুজব রটে
বরের বয়স সাতাশি।
এই খবরে দারুণ ক্ষোভে
পিত্তি জ্বলে পাবদার
রাঘব বোয়াল চেঁচিয়ে বলে
রাখো তোমার আবদার।
(বিয়ে)

সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ার জগত মূলত শিশুর স্বপ্নের পৃথিবী। যে জগতে প্রবেশ করে শিশু তার শৈশবকে আনন্দমুখর করে তুলতে পারে।