চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ঝরনাগুলোয় গত দুই বছরে আট পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ আছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ রোববার দুপুরে উপজেলার বারইয়াঢালা ইউনিয়নের বড় দারোগাহাটের পাশে মিরসরাইয়ের ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের রূপসী ঝরনায় এক পর্যটকের মৃত্যু হয়। এর এক দিন আগে শনিবার সহস্রধারা–২ ঝরনার হ্রদে ডুবে মৃত্যু হয় এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর ।
এর মধ্যে সহস্রধারা–২ ও রূপসী ঝরনায় তিনজন করে পর্যটক মারা গেছেন। গত বছরের ১৭ এপ্রিল সহস্রধারা–২ ঝরনার হ্রদে এক পর্যটকের মৃত্যুর পর পর্যটকদের নিরাপত্তায় বন বিভাগকে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু এক বছরেও তার অনেকগুলো পরামর্শ বাস্তবায়ন করেনি বন বিভাগ। ফলে আবারও ঘটেছে দুর্ঘটনা।
সীতাকুণ্ডে মোট সাতটি ঝরনা রয়েছে। ঝরনাগুলো হলো ঝরঝরি, মধুখায়া, সহস্রধারা–২, সহস্রধারা–১, সুপ্তধারা, অগ্নিকুণ্ড ও বিলাসী। আর সীতাকুণ্ডের লাগোয়া মিরসরাইয়ের ওয়াহেদপুরে রয়েছে রূপসী ঝরনা। এর মধ্যে যাতায়াতের সহজ হওয়ায় পর্যটকেরা সহস্রধারা–২ ঝরনায় বেশি যান। যাঁরা একটু পাহাড়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে চান, তাঁরা ঝরঝরি, রূপসী ও বিলাসী ঝরনায় যান। সহস্রধারা–১ ও সুপ্তধারা ঝরনা দেখা যায় বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কে গেলে।
আটটি ঝরনার মধ্যে চারটি ঝরনা বন বিভাগের পক্ষ থেকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ইজারা দেওয়া ঝরনাগুলো হলো সহস্রধারা–১, সহস্রধারা-২, রূপসী ও সুপ্তধারা ঝরনা। এর মধ্যে সহস্রধারা–২ ঝরনাটি যাতায়াতে সহজ হলেও পর্যটকদের নৌকায় চেপে একটি বড় হ্রদ পার হতে হয়। কখনো কখনো নিয়ম অমান্য করে হ্রদে গোসল করতে নেমে পড়েন পর্যটকেরা। ফলে পর্যটকের মৃত্যু হয়। আবার কখনো নৌকা থেকে পড়েও মৃত্যু হয়। হ্রদটি কমপক্ষে ৩০ ফুট গভীর। সাঁতার না জানা পর্যটকদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
সরেজমিনে গিয়ে সাংবাদিকেরা দেখেন, সহস্রধারা–২ ঝরনার হ্রদের পাড়ে একটি গাছের সঙ্গে ফেস্টুন লাগানো আছে। সেখানে লেখা আছে, ‘সহস্রধারা–২ লেকে সাঁতার কাটা ও বিপজ্জনক পথে চলাচল করা সম্পূর্ণ নিষেধ।’ একই রকম আরেকটি ফেস্টুন টিকিট কাউন্টারের পাশে লাগানো ছিল। তবে হ্রদের গভীরতা কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিতকরণের কোনো নির্দেশনা চোখে পড়েনি। হ্রদের পাড়ে চারটি লাইফ জ্যাকেট ও একটি রিং বয়া রাখা ছিল। পর্যটকেরা ঝরনায় যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ ঝরনায় হেঁটে কিংবা নৌকায় চেপে দুভাবে যাওয়া যায়। নৌকা দিয়ে সবাইকে ঝরনায় নেওয়া হয়। ইজারাদারের লোকজন টিকিট কেটে পর্যটকদের ভেতরে ঢোকাচ্ছেন। কোথাও ফরেস্ট গার্ড কিংবা বন বিভাগের লোকজনের দেখা মেলেনি।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বন বিভাগকে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। এগুলো হলো, যেসব পর্যটক একদম সাঁতার জানেন না কিংবা কম সাঁতার জানেন, তাঁদের অবশ্যই পানিতে নামতে না দেওয়া, বিপজ্জনক গর্ত কিংবা বেশি গভীরতার জলাশয়ের সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন, ইজারাদারের লোক বাড়ানো ও অনুমোদনহীন পর্যটন স্পট বন্ধ করে দেওয়া।
এসব পরামর্শ যে পুরোপুরি মানা হয়নি, তা স্বীকারও করেছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
রেঞ্জ কর্মকর্তা আরও বলেন, অনেক পর্যটক মাদকাসক্ত হয়ে আসেন অথবা পাহাড়ের ভেতরে এসে মাদক নেন। তাঁদের অনেক জায়গায় যাওয়ার জন্য নিষেধ করলেও মানেন না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। তরুণেরা ঝোঁকের বশে হ্রদ কিংবা ঝরনায় সৃষ্ট কুয়ায় নেমে পড়েন। অনেক সময় পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দেন।
পর্যটনকেন্দ্র করলে সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে কর্তৃপক্ষকেই। বিপজ্জনক স্থান চিহ্নিত করে সেখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। উচ্ছৃঙ্খল পর্যটকদের নিবৃত্ত করতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাকর্মীর ব্যবস্থা করতে হবে। এত মৃত্যুর দায় তো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।