সুপ্রভাত ডেস্ক »
সিডনি নাকি মিরপুর? ধন্দে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে থেকেই সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের চারপাশে লাল-সবুজের জোয়ার। বাংলাদেশের পতাকা হাতে, বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দর্শকের জোয়ার। কণ্ঠে বাংলায় গান, বাংলাদেশের স্লোগান। কিন্তু প্রাণের জোয়ার যে উপলক্ষ ঘিরে, সেখানেই তো ভরাডুবি! প্রবাসি বাংলাদেশিদের উৎসবের আবহ মিইয়ে গেল দলের বড় হারে।
টি-টোয়েন্টিতে দুই দলের যে বাস্তবতা, তাতে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় কিংবা বড় জয় অস্বাভাবিক নয়। তবে বাংলাদেশ পারল না ন্যূনতম লড়াই জমাতেও। অনেক আশা নিয়ে সিডনির গ্যালারিতে আসা হাজার হাজার দর্শকের উচ্ছ্বাস ক্রমে স্তিমিত হয়ে গেল সাকিব আল হাসানের দলের অসহায় আত্মসমপর্ণে। খবর বিডিনিউজের।
পরাজয়ের ব্যবধান ১০৪ রানের। রেকর্ড বই বলছে, এই সংস্করণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরাজয়। তবে পরিসংখ্যানের বাইরে পারফরম্যান্সের বাস্তবতা বলছে, ব্যবধান আসলে আরও বড়। ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে যেমন মিডিয়া সেন্টারের ডাইনিংয়ে আড্ডা দেওয়ার সময় বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ তো ম্যাচে ছিল বলেই মনে হয় না।’
বাংলাদেশ দলকে এ দিন ম্যাচ থেকে একরকম ছিটকে দেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিচিত এক মুখ। বিপিএলের দ্বিতীয় সফলতম বিদেশি ব্যাটসম্যান রাইলি রুশো তার বাংলাদেশ অভিজ্ঞতার সবটুকু কাজে লাগিয়ে উপহার দেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। এবারের বিশ্বকাপের যা প্রথম সেঞ্চুরি, তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের টানা দ্বিতীয়।
ম্যাচের পর রুশো কৃতজ্ঞচিত্তেই বললেন, বিপিএল খেলায় বাংলাদেশের বোলারদের তুলাধুনা করাটা সহজ হয়েছে তার জন্য।
রুশোর ৫৬ বলে ১০৯ রানের ইনিংস দক্ষিণ আফ্রিকাকে পৌঁছে দেয় ২০৫ রানের পাহাড়ে। ওই রান তাড়া করার শক্তি বাংলাদেশের এমনিতেও নেই। যেটুকু সামর্থ্য আছে, ব্যাটসম্যানরা পারেননি ততটুকুর ধারেকাছেও যেতে। ১৬.৩ ওভারেই তারা অলআউট ১০১ রানে।
অথচ ম্যাচের শুরুটা কী দুর্দান্তই না ছিল বাংলাদেশের! টস হেরে বোলিংয়ে নামা দলকে প্রথম ওভারেই সাফল্য এনে দেন তাসকিন আহমেদ। তার আউটসুইঙ্গারে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন প্রোটিয়া অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা।
সিডনির গ্যালারির গর্জন শুনে তখন মনে হচ্ছিল যেন শের-ই-বাংলা কিংবা জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়াম। তবে সেই আওয়াজ মিলিয়ে যেতে থাকে দ্রুতই।
উইকেটে তখন কুইন্টন ডি কক ও রুশো। এই দুজনের সঙ্গে আরেক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ডেভিড মিলারকে ভাবনায় রেখে এই ম্যাচে অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজকে একাদশে ফেরায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ওভারেই আক্রমণে আসেন মিরাজ। কিন্তু দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান মিরাজকে সামলে বাকি বোলারদের উড়িয়ে ম্যাচের মোমেন্টাম বদলে দেন চোখের পলকে।
তৃতীয় ওভারে তাসকিনের শর্ট বলে রুশোর পুল শটে বাউন্ডারিটি জানান দেয় বার্তা। তাসকিনের পরপর দুটি নো বলে ইঙ্গিত মেলে ছন্দ হারানোর। পরের দুই বলে চার-ছক্কায় ডি কক শুরু করেন ধ্বংসযজ্ঞ। যোগ দেন সেখানে রুশোও। রানের স্রোত বয়ে যেতে থাকে সিডনির সবুজ আঙিনায়।
৪.৩ ওভারেই আসে দলীয় পঞ্চাশ। মিরাজের এক ওভারে রুশোর দুটি ছক্কায় পরিষ্কার হয়ে যায়, ‘ম্যাচ-আপ’ কাজে লাগছে না এ দিন। পরে আরেক অফ স্পিনার মোসাদ্দেক হোসেনের ওভারেও চার-ছক্কা মারেন দুই বাঁহাতি।
অধিনায়ক সাকিব তবু বোলিং থেকে দূরে থাকেন অনেকটা। অবশেষে ১১তম ওভারে আক্রমণে আসেন দলের অভিজ্ঞতম বোলার। শুরুটা হয় তার দুঃস্বপ্নের মতো। টানা দুই বলে চার ও ছক্কা হজমের পর আরেকটি ছক্কা দেন ফুল টস বল করে।
রুশোর ফিফটি আসে ৩০ বলে, ডি ককের ৩৩ বলে। তাসকিনের এক ওভারে আসে ২৩ রান। ১৫ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার রান দাঁড়ায় ১৭১।
৮৮ রানে একবার ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান রুশো, থার্ড ম্যান সীমানায় বল হাতে জমাতে পারেননি হাসান মাহমুদ। এরপর কী আর সেঞ্চুরি থামানো যায়! ৫২ বলে পা রাখেন তিন অঙ্কে। আবেগময় উদযাপনে বুঝিয়ে দেন, তার কাছে ইনিংসটি কতটা ওজন।
তার শতরানের আগেই অবশ্য ডি ককের বিদায়ে ভাঙে জুটি। ৩৮ বলে ৬৩ করে কিপার-ব্যাটসম্যান আউট হন আফিফ হোসেনের বলে। ১৬৩ রানের জুটি গড়েন দুজন, বাংলাদেশের বিপক্ষে এই সংস্করণে যা প্রথম দেড়শ রানের জুটি।
শেষদিকে রানের গতিতে কিছুটা রাশ টেনে ধরতে পারে বাংলাদেশ। মুস্তাফিজুর রহমান বেশ ভালো বোলিং করেন। শেষ দিকে দারুণ সব স্লোয়ার আর বৈচিত্র দিয়ে হাসান মাহমুদও নিজের স্কিল ও শক্ত স্নায়ুর প্রমাণ দেন। শেষ ৫ ওভারে কেবল ৩৪ রান করতে পারে প্রোটিয়ারা।
সেই রানও অবশ্য ছিল বাংলাদেশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। রান তাড়ার প্রথম ওভারে যদি কাগিসো রাবাদার বলে চোখধাঁধানো দুটি ফ্লিক শঠে ছক্কায় সিডনির গ্যালারি উত্তাল করে দেন সৌম্য। তবে ২০৬ রান তাড়া করা মানে ২০ ওভার ধরে সেই ধারা ধরে রাখা। এই বাংলাদেশ কী আর তা পারে!
প্রথম দুই ওভারে ২৬ রানের পর আনরিক নরকিয়া আক্রমণে আসতেই বদলে যায় চিত্র। নিজের প্রথম বলেই এই ফাস্ট বোলার ফেরান সৌম্যকে। ওই ওভারেই তাকে স্লগ করতে গিয়ে বোল্ড নাজমুল হোসেন শান্ত।
চারে নামা সাকিবও আউট নরকিয়ার পরের ওভারে। যদিও রিভিউ নিলে বেঁচে যেতেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। কিন্তু দিনটিই ছিল এমন, কিছুই যেদিন ঠিক হয় না!
লড়াই করতে পারেননি যেমন আফিফ হোসেনও। পাওয়ার প্লেতে ৪ উইকেট হারানো দল এরপর এগিয়ে যায় ধুঁকতে ধুঁকতে। লিটন দাস কিছুক্ষণ উইকেটে কাটাতে পারলেও সেরা চেহারায় পাওয়া যায়নি তাকেও। ৩১ বলে ৩৪ করে তিনি বিদায় নেন অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে। বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় একশ পেরিয়েই।
সব মিলিয়ে বাংলদেশের জন্য চূড়ান্ত হতাশার ম্যাচ। সমর্থকেরা মাঠ ছাড়লেন মন ভার করে।
পেশাদার ক্রিকেটারদের তাকাতে হয় সামনে। সাকিব যেমন ম্যাচ শেষে বললেন, দুই দিন পরই তো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ! অপেক্ষা এখন ব্রিজবেনে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই লড়াইয়ের।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
দক্ষিণ আফ্রিকা: ২০ ওভারে ২০৫/৫ (বাভুমা ২, ডি কক ৬৩, রুশো ১০৯, স্টাবস ৭, মারক্রাম ১০, মিলার ২*, পার্নেল ০*; তাসকিন ৩-০-৪৬-১, মিরাজ ৩-০-৩২-০, হাসান ৪-০-৩৬-১, মুস্তাফিজ ৪-০-২৫-০, মোসাদ্দেক ২-০-১৬-০, সাকিব ৩-০-৩৩-২, আফিফ ১-০-১১-১)
বাংলাদেশ: ১৬.৩ ওভারে ১০১ (শান্ত ৯, সৌম্য ১৫, লিটন ৩৪, সাকিব ১, আফিফ ১, মিরাজ ১১, মোসাদ্দেক ০, সোহান ২, তাসকিন ১০, হাসান ০, মুস্তাফিজ ৯*; রাবাদা ৩-০-২৪-১, পার্নেল ২-০-১৮-০, নরকিয়া ৩.৩-০-১০-৪, মহারাজ ৪-০-২৪-১, শামসি ৪-০-২০-৩)
ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ১০৪ রানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: রাইলি রুশো।