বঙ্গ রাখাল »
আমাদের দেশ গ্রামপ্রধান। এ গ্রামের সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই বেড়ে ওঠে মানুষ। তাই মানুষকে বিকশিত করার জন্য প্রয়োজন তার নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি। পৃথিবীর আদিযুগ থেকেই দেখা গেছে যে, জাতি তার সাহিত্য-সংস্কৃতিকে যত বেশি আঁকড়ে ধরেছে, সে জাতি ততো বেশি বড় হয়েছে। আমরা আমাদের যাপিত জীবন অতিবাহিত করি আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে। বলা হয়ে থাকে, মানুষকে ধ্বংস করতে হলে বা বিপদগামী করতে হলে তার মধ্য থেকে তার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি কেড়ে নিতে হবে অথবা বিজাতিক সাহিত্য সংস্কৃতির বীজ তাদের অন্তরে রোপণ করে দিতে হবে। তবে সে জাতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে।
সাহিত্য-সংস্কৃতি আসলে কী? ‘Literature is the reflection of human character.’ সাহিত্য হচ্ছে মানব চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। সাহিত্য-সংস্কৃতি মানুষকে সত্যকে সত্য, আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শেখায়। আর এ সাহিত্যের একটি বড় অংশ পল্লীসাহিত্য। আমরা প্রতিনিয়ত গ্রামে দেখতে পাই গাজিগানের আসর, তেমনি করে কীর্তন, অষ্টক, ধূয়ো, ভাসান যাত্রা, মেয়েলি গীত, কৃষকের ধানের গান, রাখালের গান, কিচ্ছা গান ইত্যাদি। এসব আমাদের শিক্ষা দেয় মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলাবোধ। একসময় গ্রামগুলোতে হৈ-চৈ, ডাকাতি, চুরি, ঝগড়া লেগেই থাকতো। কিন্তু এসব গান বাজনা হওয়ার কারণে মানুষের মধ্য থেকে আস্তে আস্তে খারাপ কাজগুলো বিতাড়িত হলো। সে সময় মানুষ গান বাজনাকে বলতো জ্ঞান। কারণ গান বাজনায় মানুষের হৃদয় প্রসারিত হয়। তাইতো সে গানগুলোকে তারা জীবন্ত করে তুলতো। এ গ্রামপ্রধান দেশের প্রতিটা গ্রামেই রয়েছে নিজস্ব কিছু সাহিত্য-সংস্কৃতি। গ্রামের মানুষ সে সব সাহিত্য-সংস্কৃতিকে লালন করেই বেড়ে ওঠে। প্রতিটা গ্রামের পরতে পরতে রয়েছে সাহিত্যের উপাদান। এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া বা অস্বীকার করা কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এক সময় গ্রামগুলোতে পাড়ায় পাড়ায় গানের দল হতো। তারা পাড়ায় পাড়ায় গান করে বেড়াত। তেমনই ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলার গোলকনগর গ্রামেও এক সময় ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির রমরমা অবস্থা। প্রতিটা গ্রামেই সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্মকাণ্ড গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে অনেক বিস্তৃত ইতিহাস।
কিন্তু আজ আমাদের গ্রামগুলো শ্মশানস্বরূপ। গ্রামগুলোতে গান বাজনা হয় না। গ্রামগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হয় না। আবার কোথাও কোথাও সাহিত্যের কর্মকাণ্ড চললে সেখানে শুরু হয় ক্ষমতার দাপট। সভাপতি হওয়ার বাড়াবাড়ি। কিন্তু সবাই মিলে যে বসবাস করব সে চিন্তা কারও নাই। আজ মানুষের চেয়ে ধর্ম বড়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো’। গ্রামগুলোতে আজ গান নেই, গীত নেই, বিশুদ্ধ বায়ু নেই, গাছের মরমর ধ্বনি নেই, কোকিলের কুহু কাকলি নেই, কিছু নেই। সেখানেও স্থান করে নিয়েছে রাজনীতির নোংরামি। আজ গ্রামেও লেগে থাকে অস্থির অবস্থা। গ্রামেও আজ লেগেছে শহরের বায়ু। তাই তো গ্রামগুলোতে এখন সবুজ শ্যামল পরিবেশ নেই, কাঁদামাটির ঘর নেই, কাঁদামাটির বদলে উঠছে আকাশ সমান দালান। আমাদের দেশেও এসে দোলা দিয়েছে বিজাতীয় সাহিত্য। আবার আকাশ সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে থেকে কেড়ে নিচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতি। গ্রামের সাদা সিধা, আলাভোলা মানুষগুলোকে বানাচ্ছে ভণ্ড প্রতারক, হায়েনা। আমরা এখন আর তুলসীতলায় যাই না। পাখির গান শুনি না। যাই না কীর্তন গানে, এখন আর গাজীর গানের আসর বসে না। তাই আমাদের সবাইকে নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের দিকে নজর দিতে হবে। মাটি হতে রস শোষণ করতে না পারলে যেমন গাছ পরগাছা হয়। তেমনই আমরাও নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি বাদ দিলে পরগাছায় পরিণত হব। তাই সময় থাকতে আমাদের এখনই সচেতন হওয়া উচিৎ। নয়তো সময় গেলে সাধন হবে না।