রায়হান আহমেদ তপাদার »
বর্তমান যুগে সম্পর্কের আনুষ্ঠানিকতার মাত্রা যে হারে বেড়ে যাচ্ছে, তা দেখে রীতিমতো ভয় হয়। সম্পর্কের এই ধরন ধীরলয়ে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে নগরায়ণ ও ভূগ্রামের দেশগুলোয় যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। করোনাকালের সঙ্গে এর সম্পর্ক খোঁজার প্রয়োজন নেই। করোনাকালে মানুষে মানুষে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সঙ্গত কারণে অনেক কমে গেছে। করোনা-পূর্বকালে কি যোগাযোগ খুব বেশি ছিল? সবাই মিলে একত্র হয়ে সামাজিক উদ্যোগে সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ, পাড়া-প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়ার মতো অনানুষ্ঠানিক ও আন্তরিক যোগাযোগগুলো এখন আর দৃশ্যমান নয়। সামাজিক মাধ্যম মানুষের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবন থেকে মূল্যবান সময় কেড়ে নিয়ে তাদের আসক্ত করে ফেলে। ফলে তাদের সামাজিক দক্ষতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় ও অসামাজিক আচরণ বেড়ে যায়। সামাজিক মাধ্যমগুলো অপরাধীদের জন্য একটি হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষে মানুষে যে কাছে আসা কাক্সিক্ষত, করোনাকালে দেখছি সেই কাছে আসা নিয়েই ভয়! কারণ, করোনা মানুষ থেকে মানুষেই সংক্রমিত হয়। ফলে পরস্পরের শারীরিক দূরত্ব জরুরি। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে সঙ্গত কারণেই সকলকে সামাজিক বা শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। ফলস্বরূপ, সামাজিক জীবনযাপনের নতুন অনুষঙ্গ হতে যাচ্ছে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা। এ থেকে আমাদের মনের ভেতরে গেঁথে গেছে এক অজানা আতংক।
এখন ভাবার বিষয় যে, হাত মেলানো, কোলাকুলি, ঘাড়ে হাত দেয়াসহ কিছু সামাজিক ঘনিষ্ঠতার আচরণগুলো কি পরিবর্তিত হবে? নাকি সম্পর্ক দৃঢ় করতে অন্য মাধ্যম অবলম্বন করতে হবে? করোনা ঝড়ের কবলে পড়ে পুরো বিশ্ব আজ স্থবির। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। বিরাজ করছে যুদ্ধ-বিগ্রহ, দুর্ভিক্ষ, বিপ্লব কিংবা বিদ্রোহ কালের পরিবেশ। থমকে দাঁড়িয়েছে সবকিছু। সবাই ভীত-বিহ্বল, উদভ্রান্ত। যার করালগ্রাসের প্রভাব পড়ছে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে। পৃথিবীতে যে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে এর প্রভাব অনেক গভীরে। এজন্য সভ্যতার গতি শুধু থেমেই যাবে না বরং পিছিয়ে দেবে কয়েক দশক। তবে নিয়মানুযায়ী, এই পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এখন সবচেয়ে বড় উপলব্ধির বিষয় হচ্ছে- কেমন হতে পারে করোনা পরবর্তী পৃথিবী? কী কী পরিবর্তন আসতে পারে আমাদের সামগ্রিক জীবনাচরণে? কিংবা করোনাউত্তর পরিস্থিতিতে সামাজিক সম্পর্ক, সমাজ কাঠামো ও সামাজিকীকরণের নতুন বিন্যাস কেমন হবে?
এমনিতেই আমাদের দেশে সামাজিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়িত্ব বোধের অভাব রয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস প্রভাব। ফলে সামাজিক দূরত্ব আরো বাড়ছে এবং মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, হতাশা, নিঃসঙ্গতা বোধের এক ধরনের সুপ্ত চাপ বিরাজ করছে। সমাজে মানবিক সংকটের কিছু চিত্র স্পষ্ট দৃশ্যমান হচ্ছে। যেগুলো আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষ করে তুলেছে অসামাজিক। বস্তুত ভার্চুয়াল যোগাযোগের সুযোগ যত বাড়ছে, মানব সম্পর্ক তত ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। কাছে আসার ছলে মানুষ চলে যাচ্ছে দূরে। সম্পর্কের জাল যত বিস্তৃত হচ্ছে, সম্পর্কের মূল্য বিষয়ে মানুষ তত বেশি বেখেয়াল হয়ে যাচ্ছে। এখন সম্পর্ক আলগা, হৃদয়াবেগরহিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবারিত ব্যবহারের কারণে মানবীয় সম্পর্কের আবেগ ও হৃদয়ানুভূতি হারিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের বন্ধুর সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও প্রকৃতপক্ষে তাকে বন্ধুহীন করে ফেলেছে। শিল্পবিপ্লবের পর মানুষ নিঃসঙ্গ শুরু করে, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে সে হয়ে পড়েছে চরম নিঃসঙ্গ। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে সে একা। এসব সমস্যা শুধু তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মধ্যবয়সী, এমনকি প্রবীণদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে এই আসক্তি। সাম্প্রতিক করোনাকালে সংক্রামক রোগের কারণে রোগীকে হেয় করার প্রবণতাটি আবারও বিশ্বজুড়ে দেখা দেয়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়,করোনাভাইরাস-কেন্দ্রিক সামাজিক কলঙ্ক কেবল সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান বা প্রকাশিত হয় না বরং আমাদের গবেষণার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে অনেক মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যেও সামাজিক কলঙ্ককে কেন্দ্র করে একধরনের ভীতি বা সমাজে হেয় হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে শহরের ঘটনাগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক প্রচার পেয়েছে মাত্র। পাশাপাশি শহর এলাকার অনেকের মধ্যেই ‘একঘরে’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর গোপন রাখার প্রবণতা দেখা গেছে। এর সঙ্গে মানুষের সামাজিক মর্যাদাহানির বিষয়ও সরাসরি যুক্ত। এতে তাদের সামাজিক মর্যাদাহানির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেরও ঝুঁকি তৈরি করেছে।এই কলঙ্ক প্রসঙ্গে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনোরোগ নৃবিজ্ঞানী আর্থার ক্লেইনম্যান ইলনেস ন্যারেটিভ নামে একটি বইয়ে বলেন, সামাজিক স্টিগমার কারণে পরিবারের নিকটতম মানুষজন ছাড়া বাকিরা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে সরে যায় এবং তাকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। এর মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তি আরও বেশি মানসিক চাপে ভুগতে থাকে। বিষয়টি তার সুস্থতার পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুঃখজনকভাবে আমরা এর চেয়েও কষ্টকর উদাহরণ দেখতে পাই, যেখানে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি ভয়ের কারণে তাকে একঘরে করে রাখা, এমনকি তাকে খাবার না দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। করোনা আক্রান্তদের প্রতি নানা সামাজিক নিগ্রহ ও অসৌজন্যমূলক আচরণ, সন্তান মাকে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া, মৃতদের দাফনে বাধা প্রদান, ত্রাণের কথা বলে ধর্ষণসহ যত অমানবিক, অসামাজিক কাজ আছে সবই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এতো কিছুর মধ্যে কিছু বিষয় আশার সঞ্চার করছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই এ মহাবির্পযয়ে এগিয়ে এসেছে। নাগরিক দায়িত্ববোধ পালনের প্রবণতা ব্যাপকতর হচ্ছে। এটাই বাস্তবতা যে, করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের জীবনধারণ করতে হবে।
করোনা এই পৃথিবীতে কতদিন থাকবে তা অনুধাবন করা খুবই দুষ্কর। এছাড়া নতুন প্রজন্মের একটা অংশ বাস্তব জীবন থেকে ভার্চুয়াল জগতের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্মে অনলাইন নির্ভরতা বাড়ছে। শুধু করোনা ভাইরাসই এক ধাক্কায় এতকিছু পরিবর্তন করে দিচ্ছে। পিঠে, মাথায় বা কাঁধে হাত দিয়ে উৎসাহ দেয়া, স্নেহ করা বা আবেগপূর্ণ পরিস্থিতিতে সান্ত¡না দিতে জড়িয়ে ধরা প্রকৃতিগতভাবে সম্পর্ককে আরো মজবুত করে। কিন্তু এর বৈপরীত্যের চাপ স্পষ্ট। সঙ্গরোধ ও সামাজিক দূরত্বের বিধান মানতে গিয়ে মানুষ নানাভাবে আক্রান্ত হবে। প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নীতি, নৈতিকতা ও প্রথায় ফাটল দেখা দেবে। চিন্তা-ভাবনার মধ্যেও চলে আসবে নানা বিভ্রান্তির বেড়াজাল। মানুষের মনস্তাত্ত্বিকতাও বিপন্ন হবে। ফলে সর্বত্র বিরাজমান এক গভীর অসুস্থতার ছাপ সমাজ ও মানুষের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও প্রকাশ পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও আশপাশের মানুষ, এমনকি নিকটাত্মীয়স্বজনেরাও তার সঙ্গে আর আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছে না।
এছাড়া আমাদের দেশে সঠিক পরামর্শের সুযোগ একদমই কম।এ ক্ষেত্রে আমরা কলঙ্কের যে কটি ধরন, তার মধ্যে অন্যতম হলো আক্রান্ত ব্যক্তিকে অগ্রাহ্য, অবহেলা করা, আক্রান্ত ব্যক্তির (নারী) বিয়ে ভেঙে যাওয়া, কাজের ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলা বা চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয়, আত্মীয়স্বজনদের দূরে সরে যাওয়া, পরিবারের মানুষের অবহেলা ও খাবার না দেওয়া, সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়া, আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলে মৃতদেহ ফেলে চলে যাওয়া ও সৎকার না করা ইত্যাদি। সংক্রমণের ভয়ে সাধারণ চিকিৎসা না দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। এসব বিভিন্ন রকম কলঙ্কের মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানেরও অবনতি ঘটে, যা সমাজে তার আত্মপরিচয়কে সংকটাপন্ন করে তোলে, যা সমাজ বিজ্ঞানী গফম্যানও তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার বিষয়টি ঘটে থাকে প্রধানত অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং সংক্রামক রোগের প্রতি অযাচিত ভয় থেকে।
এই ভয় তৈরি করার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভ্রান্ত ধারণা ও তথ্য অনেক ভূমিকা পালন করে থাকে বলেও মতামত এসেছে। কেননা অনেকেই খুব সহজেই ভ্রান্ত ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অতিসাবধানতার বশবর্তী হয়ে এমন কিছু করছেন, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এসব আদতে ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও পরিবারকে সমাজে নানাভাবে হেয় করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ জন্য করোনার মতো সংক্রামক রোগের কারণে আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যা আমাদের কলঙ্ক তৈরির আচরণ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করবে। রোগীর সঙ্গে অসুস্থতার সময়ে নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলার মানেই কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা নয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে হেয় ও অবহেলা না করে বরং তার রোগমুক্তির জন্য মানসিক শক্তি অর্জনে সাহায্য কারা অধিক জরুরি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স