বাসিংথুয়াই মার্মা
আমরা পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা ছিল না। ছিল আমাদের দুজনের সংস্কার, মূল্যবোধ ও বাস্তবতা। অদম্য সাহসিকতা দেখানো যেত, তাতে আমাদের একে অন্যকে হারিয়ে ফেলবো, এ ভয় পেয়ে বসেছিল। প্রতি সপ্তাহে কোন না কোনদিন আমাদের দেখা হতো, মানে দেখা হয়ে যেত। যতটুকু মনে পড়ে, সে ছোট একটি জব করতো, প্রায়ই বলতো, মা-বাবা, ভাইবোন নিয়ে তার কোন চিন্তা নাই। তার মনের ভিতর গভীর আনন্দ বিরাজ করতো। কোনদিন নিজের কষ্টের কথা শেয়ার করতো না। অন্যের কষ্টের বিষয়ে অনুভব করতো। মা দুর্গার মতো তার সকল পরিচিতদের যে কোন বিপদে হাত বাড়িয়ে দিত।
শেষবার কেনটাকির ঘটনার পর আমি চেষ্টা করছিলাম তাকে এড়িয়ে যেতে। চাইলেও কি সম্ভব! প্রকৃতির আকাশে শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষ আসতে পারে। কিন্তু সে আমার কাছে পূর্ণিমার চাঁদের মতোই ছিল।
যতদূর মনে পড়ে, ২০০৩-এর শীতকাল। কোন এক শুক্রবার। দুজনে প্রস্তুতি ছাড়াই বের হয়ে ডিসি হিল পার্কে আসলাম। বিকাল বেলা ডিসি হিল পার্কে বেড়াতে আসা মানুষে ভর্তি। কে কাকে চেনে! আমরা যুগলের মতো বসে কত কিছু আলাপ করলাম। শুধু বলা হলো না নিজেদের কথা, নিজেদের চাওয়ার কথা, নিজেদের স্বপ্নের কথা, একে অন্যকে পছন্দের কথাটা। মনের সাথে মনের যুদ্ধতে আমরা কখনো ট্রয়নগরে, কখনো বা পলাশির আম্রকাননে! এ যেন এক প্রতিরোধযুদ্ধ। যে যুদ্ধের প্রতিপক্ষ স্বয়ং আমরা নিজেরাই। যুদ্ধে প্রতিপক্ষ থাকলে হারজিত দৃশ্যমান হয় বটে, নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে মেহেদি পাতার মতো ভিতরে রক্তাক্তই হই, বাইরে সবুজই থাকে। হারজিত দেখা যায় না। আমরা আমাদের হৃদয়ের রক্ত কেউ নিজেদের দেখাতে পারিনি, নীরবেই অনুভব করেছি।
ডিসি হিল পার্কে আনুমানিক আমরা সন্ধ্যা ৭.৩০ অবধি থাকার পর দুজনে পাশাপাশি অনেকক্ষণ হেঁটেছিলাম। সে তখন তৃতীয় তলার একটি বাসায় চিলেকোঠার ছোট ব্যাচেলর বাসায় থাকতো।
হাঁটতে হাটঁতে কি মনে করে বলল, চলো আজ আমার বাসায়। তোমাকে আজ নিজ হাতের তৈরি করা কফি খাওয়াবো। কেনটাকির কফি, নাকি আমার হাতের কফি, কোনটা ভালো খেয়ে জানাবে।
ওর কথা শুনে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে আমার চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের আমার অসামর্থ্যরে কথা ভুলানোর জন্য কথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, আমি বুঝতে পারি। হাঁটি হাঁটি পা পা করে তার চিলেকোঠার বাসায় চলে গিয়েছিলাম।
ততক্ষণে রাত প্রায় ১০টা। বাইরে প্রচ- শীত। মুচকি মুচকি হেসে বলছিল, আজ আমার হাতের রান্না খেয়ে যাও, হোস্টেলে থাক, কি ছাইপাঁশ খাও!
আমার মনে কি প্রকার ঢেউ যে আসছিল, সেটা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। বাসায় আমরা দুজন। চিলেকোঠার বাসা। দরজার সাথে বিশাল ছাদ। নিরিবিলি আকাশ। শীতের কুয়াশাবুড়ির চাদরে ঢাকা বলে কিছুই দেখা যাচ্ছি না।
রাতের ভাত খেতে খেতে ১১ টা বেজে গেল। খাওয়ার পর আমি যেতে চাইলে সে বাধা দিয়ে বলল, এ ঠান্ডায় তোমাকে আর বের হতে হবে না। তোমার তো ঠান্ডাজনিত সমস্যাও আছে। থেকে যাও, কাল সকালে এখান থেকে ক্যাম্পাসে যেতে পারবে! তার প্রস্তাব শুনে আমি হ্যাঁ বলবো নাকি না বলবো, বুঝতে না পেরে আকাশের তারা দেখছি দুচোখে।
মনের ভিতর সমুদ্রের গর্জন। হিমালয় পর্বত থেকে হিমবাহ বেয়ে আসা বরফের খ- যেন আমার মনোজগতে ঢেউ খেলিয়ে চলেছে অনবরত।
বারান্দার রুমে আমাকে বিছানা করে দিয়ে ভিতরের রুমে গিয়ে হুক লাগিয়ে আলো নিবিয়ে ঘুমিয়ে গেল সে। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে সারারাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি। যেন সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে নতুন ইউক্লিড ও মৈত্রীয় দেবী। আমরা যেন, ‘লা নুই বেঙ্গলি’ এবং ‘ন হন্যতে’।
সকাল হওয়ায় আমাকে ডেকে দিল সে। আমি ফ্রেশ হতে হতে সে প্রাতঃরাশ প্রস্তুত করে বলল, খেয়ে যাও, দোকানে যাবার দরকার নাই। সকালের খাবার খেয়ে ক্যাম্পাসে গিয়েছি। সারাদিন ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারিনি। আমি আজ অবধি বুঝে উঠতে পারছি না, এটা কিসের সংকেত ছিল! এ কি প্রেমের আহ্বানের সংকেত, নাকি সে ছিল কোন বিশ্বস্ত বন্ধুর প্রতি প্রেরণাদায়ক ভুমিকা?
সে এবং আমি আমাদের মতো করে সময়কে খুব কাছ থেকে ছোঁয়ার সুযোগ পাওয়ার পরও আমরা বুঝেনি, ‘সময়’ আমাদের ছিল। কালের যাত্রায় আমরা দুজন দুটি পথের পথিক।
আমাদের পথ রেল লাইনের মতো সমান্তরাল। যদিওবা কোনদিন কোন স্টেশনে একত্রে পৌঁছালেও আমাদের অবস্থান কি কখনো এক ও অভিন্ন শেষপথ হবে? আমাদের এ অবিস্ফোরিত মেট্রোপলিটন ‘প্রেম’।
তুমি রবে নীরবে! হয়তোবা আগামীর নতুন কোন লাজুক যুগলের ওপর ভর করে পৌঁছে দেবে নতুন কোন অপ্রকাশিত কাব্যের কাছে!