হানিফ রাজা »
সবুজেঘেরা মিলনপুর নামে একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল। গ্রামের চারপাশে ছিল সবুজ ক্ষেত, বাঁশঝাড়, দিঘি আর বিল-ঝিল। গ্রামে অনেক ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছিল। তারা সারাদিন মাঠে দৌড়ে বেড়াত, নদীতে সাঁতার কাটত, কখনো গাছে চড়ে পাকা আম কুড়াত। খেলাধুলা, দুষ্টুমি এসবেই দিন কেটে যেত। কিন্তু বই-খাতা খুলে বসা যেন তাদের জন্য খুব বিরক্তিকর কাজ। কেউ মন দিয়ে পড়তে চাইত না।
গ্রামের স্কুলটা ছিল কাঁচা ইট আর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি। সেখানে পড়াতেন বৃদ্ধ শিক্ষক হক মাস্টার। তিনি যতই চেষ্টা করতেন, বাচ্চাদের পড়ায় মন বসত না। একদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন গ্রামে এলো নতুন শিক্ষক- নাম সাদেক স্যার।
সাদেক স্যার বয়সে তরুণ, হাসিখুশি আর বাচ্চাদের সঙ্গে খুব সহজে মিশে যান। প্রথম দিনেই তিনি মাঠে গিয়ে দেখলেন, স্কুলের অনেক বাচ্চাই পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে খেলায় মগ্ন। তিনি ডেকে বললেন,
“বাচ্চারা, তোমরা সবাই খেলছো কেন? ক্লাসে যাচ্ছো না কেন?”
রাহিম নামের এক দুষ্টু ছেলে হেসে উত্তর দিল,
“স্যার, খেলাই তো মজা! বই পড়লে মাথা ব্যাথা করে।”
সবাই হেসে উঠল।
স্যারও হেসে বললেন,
“তাহলে আমি একটা খেলার গল্প শোনাই, কেমন?”
সব বাচ্চা ছুটে এসে তাঁর চারপাশে বসে পড়ল। স্যার বলতে শুরু করলেন,
“একটা ছেলে ছিল, নাম তার শুভ। সে সবসময় খেলায় মজা করত, পড়াশোনা করত না। একদিন খেলতে গিয়ে সে জঙ্গলে হারিয়ে গেল। পথ চেনার মতো জ্ঞান তার ছিল না, কারণ সে কখনো ভূগোল পড়েনি। তখন সে খুব ভয় পেল। যদি সে পড়াশোনা করত, তাহলে ্এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হয় তা জানত।”
গল্প শুনে বাচ্চারা চুপচাপ হয়ে গেল। স্যার আবার বললেন,
“পড়াশোনা করলে শুধু বইয়ের অঙ্ক কিংবা অক্ষর শেখা হয় না। পড়াশোনা মানুষকে সাহসী করে, নতুন কিছু জানায়। বই হলো ডানা এই ডানায় ভর করে মানুষ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে।”
মিনা নামের এক বুদ্ধিমতী মেয়ে জিজ্ঞেস করল,
“স্যার, বই পড়ে কি আমরা সত্যি উড়তে পারব?”
স্যার মিষ্টি হেসে বললেন,
“অবশ্যই! তবে সেটা আকাশে পাখির মতো ওড়া নয়। বই তোমাদের নিয়ে যাবে দূরের দেশ, নতুন জগত আর স্বপ্নের রাজ্যে।”
কথাগুলো শুনে বাচ্চাদের চোখে কৌতূহল জেগে উঠল।
পরের দিন স্যার ক্লাসে এসে নতুন খেলা শুরু করলেন। তিনি একটা গল্পের বই বের করে বললেন,
“আজ আমরা বই পড়া দিয়ে খেলা করব। আমি এক লাইন পড়ব, তোমরা পরের লাইন একসাথে পড়বে।”
শুরু হলো মজার খেলা। প্রথমে বাচ্চারা জড়তা বোধ করলেও ধীরে ধীরে তারা আনন্দ পেতে লাগল। গল্পের চরিত্র নিয়ে হাসাহাসি, প্রশ্নোত্তর, এমনকি অঙ্কের ছক কষাও যেন মজার খেলায় পরিণত হলো।
একদিন স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে লিখলেন
“আমরা পড়বো, আমরা শিখবো, আমরা বড় হয়ে দেশ গড়বো।”
তিনি বাচ্চাদের দাঁড় করিয়ে একসাথে এই শ্লোগান দিতে বললেন। মাঠজুড়ে প্রতিধ্বনি উঠল
“আমরা পড়বো, আমরা শিখবো, আমরা বড় হয়ে দেশ গড়বো।”
ধীরে ধীরে গ্রামে বদল আসতে লাগল। সন্ধ্যা হলে আর শুধু খেলাধুলার আড্ডা জমত না। সবাই বই-খাতা নিয়ে একসাথে বসত। কারো পড়ায় সমস্যা হলে অন্যরা সাহায্য করত।
রাহিম, যে একসময় বইয়ের নাম শুনলেই মুখ বাঁকাত, এখন অঙ্কের সমস্যায় বন্ধুদের সাহায্য করত। মিনা গল্প লিখে সবাইকে শোনাত। কামাল আঁকাআঁকি করে বইয়ের পাতায় সুন্দর ছবি আঁকত। বই হয়ে উঠল তাদের সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী।
কিছুদিন পর জেলা পর্যায়ের একটি কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গেল মিলনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। আশেপাশের অনেক স্কুল সেখানে অংশ নিয়েছিল। প্রতিযোগিতায় সবার আগে নাম ঘোষণা হলো মিলনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেদিন গ্রামের সেই খেলাধুলাপ্রিয় বাচ্চারা পড়াশোনার জোরে দারুণভাবে উত্তর দিল। তারা প্রথম স্থান অর্জন করল।
পুরস্কার হাতে পেয়ে রাহিম উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“স্যার, যদি আপনি আমাদের খেলাধুলার ফাঁকে পড়াশোনার মজা না দেখাতেন, আমরা কোনোদিন এভাবে জিততে পারতাম না।”
স্যার হেসে বললেন,
“তোমাদের মনেই প্রতিভার শক্তি ছিল, আমি শুধু তা জাগিয়ে তুলেছি।”
সেদিন থেকে গ্রামের সবাই বলত,
“মিলনপুরের বাচ্চারা শুধু খেলায় নয়, পড়াশোনাতেও সবার সেরা।”
গ্রামের প্রতিটি শিশুর মুখে তখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল
“আমরা পড়বো, আমরা শিখবো, আমরা বড় হয়ে দেশ গড়বো।”