সাথী ও দুষ্টু

অরূপ পালিত »

সাথী দুই তিন দিন হতে সন্ধ্যার পরে বেরিয়ে যায়। সকাল-সকাল চুপিচুপি ফিরে। এসে নাওয়া খাওয়া ভুলে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু ঘুম। ইদানিং নিয়মিত ভাতও খেতে চায় না সে। কী সুন্দর লোমগুলো ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। সাথী কে নিয়ে মহা সমস্যা পড়েছে রোদ্দুর। পরীক্ষার টেনশন থেকে সাথীকে নিয়ে টেনশনে আছে বেশি। করোনার কারণে ইদানিং ঘরের মধ্যে কেউ সাথীকে পছন্দ করেছে না। রোদ্দুরের মা সাব জানিয়ে দিয়েছেন। ওকে যেন নদীর ওই পারে দিয়ে আসে।
রোদ্দুর মা ক্রুদ্ধ, বিশেষ করে ওর মামার পায়ে আচঁড় লাগার পর। সাথী কিন্তু ইচ্ছে করে করে আঁচড় দেয়নি। সব দোষ রোদ্দুর মামার। ইচ্ছে করে উনি সাথীকে লাথি মেরেছে। সে কারণে মামার গায়ে সাথীর আঁচড় লাগে। সেদিন সাথীকে হাতের কাছে যা পেয়েছে সবাই মেরেছে । সাথীর একটি পায়ে অনেক ব্যাথা পেয়েছে। তাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে।
রোদ্দুর সকালে পরীক্ষা দিতে বের হচ্ছে। এমন সময় দেখে সাথী আরেকটা বন্ধুকে নিয়ে খাটের নিচে খেলছে। রোদ্দুর সেটা দেখে অবাক হয়ে যায়। দুটো দুই মেরুর প্রাণী। এদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় কীভাবে?
রোদ্দুর ছোট থেকে মা-বাবার মুখে শুনে আসছে, বিড়াল আর ইঁদুর একজন আরেকজনের শত্রু। এদের মধ্যে কোনদিন বন্ধুত্ব হয় না। তাহলে সাথী কি ওকে খেলতে-খেলতে খেয়ে ফেলবে?
দেখতে পারলে কী মজা না হতো। এইসব ভাবতে ভাবতে রোদ্দুর পরীক্ষা দিতে চলে যায়।
রোদ্দুর পরীক্ষা দিয়ে এসে দেখে ওর মা সাথীকে খুব মারছে। কারণ এইটা। ঘরের থেকে শত্রুকে না তাড়িয়ে ওর সাথে খেলছে। গতবছর রোদ্দুর মামা বিদেশ থেকে একটা কম্বল এনেছিলেন। সেটা ইঁদুরে কেটে দিয়েছিল।
সাথী রোদ্দুরের কথা বুঝতে পারে। সাথীকে রোদ্দুর আয় আয় বলার সাথে সাথে খাটের নিচ থেকে দৌঁড়ে চলে আসে। সাথী রোদ্দুরকে লেজ দিয়ে আদর করে বুঝাতে চাইছে ওর বন্ধুটি খারাপ না। ওকে যেন না মারি। ও এখন সাথীর বন্ধু।
রাতে ঘুমানোর সময় রোদ্দুর দেখে সাথী ইঁদুরটি বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। রোদ্দুরের মা যাতে ওদেরকে দেখতে না পায়, দু’জনকে গায়ের ওপর একটি পুরানো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। ওদেরকে এমন অবস্থায় দেখে রোদ্দুরের খুব মায়া হয়। তিন-চারদিন থাকার পর ইঁদুরটি রোদ্দুরকে দেখে আর ভয়ে পালিয়ে যায় না। রোদ্দুর ইঁদুরটিকে আদর করে নাম রাখে দুষ্টু। রাতে চুপি চুপি করে দুষ্টুর জন্য বিস্কিটের গুঁড়া এনে দেয়।
প্রতিদিন রোদ্দুর সকালে স্কুলে যাবার সময় খাটের নিচে একটি বাটিতে করে কিছু খাবার দিয়ে যায়। মায়ের চোখের আড়াল করে দিলেও মা সব টের পায়। রোদ্দুর মা বুঝতে পারেন। রোদ্দুর সারাদিন লেখাপড়া না করে সাথীকে নিয়ে ব্যস্ত। সাথীকে সে কারণে আরো অপছন্দ। একদিন ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে রোদ্দুরের মা খাটের নিচে দেখেন মুরগির হাড় এবং কলিজা। তিনি বুঝতে পারেন এইগুলো সাথীর কাজ। এই কারণে সাথীকে হাতের কাছে যা পায় তা দিয়ে তাড়া করে।
এই কাজ যে দুষ্টু করেছে রোদ্দুর আগে দেখেছে। নিচের কাঁচা বাজারের পাশে অনেক মুরগির দোকান আছে। সেখান থেকে সাথীর জন্য দুষ্টু এইসব নিয়ে আসে। রোদ্দুর মনে মনে চিন্তা করে, এইটা মনে হয় ওদের চুক্তি। থাকার পরিবর্তে খাবার এনে ঘুষ।
রাতে রোদ্দুর মা রোদ্দুরকে দুধ দিয়ে চলে যাবার সময় দেখতে পায় খাটের নিচে কিছু একটা নড়ছে-চড়ছে। সেটা দেখতে গিয়ে দেখতে পায় আবার সাথীকে, সে আরামে বসে ইঁদুরটিকে নিয়ে খেলছে। তাড়াতাড়ি করে বেত নিয়ে সাথীকে মারতে থাকে। দুষ্টু কোন রকমে পালায়। সাথী রোদ্দুরের মার খেয়ে সেইদিন যে ঘর ছেড়েছে, আর আসেনি। কয়েক বছর পার হয়ে গেছে। রোদ্দুরের এখন আর সাথীর জন্য মন খারাপ হয় না। সে এখন শালিক পুষেছে। শালিকটাও ভারী মিষ্টি।
রোদ্দুর একদিন ওর বাবার সাথে রেয়াজউদ্দিন বাজারে মুরগি কিনতে যায়। মুরগি কাটার সময় রোদ্দুর একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ একটি বিড়াল এসে রোদ্দুরকে লেজ নেড়ে পায়ের কাছে বসে পড়ে। রোদ্দুর ও বাবারে করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। দোকানদার দৌঁড়ে আসে লাঠি হাতে নিয়ে, বিড়ালটিকে মারতে। রোদ্দুর কেঁদে বলে ওকে মেরোনা। ও আমার সাথী। রোদ্দুরের বাবা বিড়ালটিকে দেখে চিনতে পেরেছেন। সে আসলে সাথী। রোদ্দুর সাথীকে আদর করে জিজ্ঞেস করল, সাথী! দুষ্টু কোথায় রে ? সে মনে হয় বেঁচে নেই।
মুরগী কাটার পর অবশিষ্ট অংশ যে ড্রামে জমিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে দুষ্টু কিচ কিচ শব্দ করে বেরিয়ে আসলো। রোদ্দুর সাথীকে কেঁদে-কেঁদে বলে মা মেরেছে বলে তোর অভিমান হয়েছে! না। তুই বড় স্বার্থপর। আমাকে একটু দেখতে যেতে পারিস না। জানিস আমার মা-ও আমার কাছ থেকে, তোর মতো হারিয়ে গেছে। তোকে তো পেয়েছি। আমার মাকে কি আর পাবো? সবাই বলে মা আকাশের তাড়া হয়ে গেছে। এইসব দেখতে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। এমন ভালোবাসার দৃশ্য দুই-একজন লোক মোবাইলে স্মৃতিবন্দি করে তুলে নেয়। এক বৃদ্ধ লোক চোখ মুছে বললেন। মানুষের চেয়ে পশুদের বিবেক এবং মানবতা বড্ড বেশি। প্রাণি হয়েও সে তাঁর মনিবকে চিনতে ভুল করেনি।
দুষ্টু মানুষের জড়ো হওয়া দেখে ভয়ে তাড়াতাড়ি করে নালার মধ্যে নেমে যায়। সাথী রোদ্দুরকে লেজ দিয়ে আদর করে মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয়। সে এখানেই খুব ভালো আছে। এখানের মতো অমন সুখ চার দেয়ালের বন্দিঘরে নেই।
সাথী একটি মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে দুষ্টুর পেছন-পেছন ফিরে যায় তার আপন ঠিকানায়।