হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
সমস্ত প্রশংসা, গুণগান ও স্তুতির মৌলিক হকদার আল্লাহ্ তাআলা যিনি চিরস্থায়ী, চিরঞ্জীব, শাশ্বত, অবিনশ্বর। তাঁর পবিত্রতা ও কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনে পবিত্র বিধান আরোপ করে মহিমা ও সৌন্দর্যে ধন্য করেছেন। যাতে পরকালীন স্থায়ী জীবনে আমরা অনাবিল সুখ-শান্তি ও অফুরন্ত নেয়ামতে সমৃদ্ধ হতে পারি।
আমাদের মনের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকারোক্তি হলো, আল্লাহ্ তাআলা এক, অদ্বিতীয়, অক্ষয়, অমর। একমাত্র উপাস্য তিনিই। তিনি ¯্রষ্টা, জীবনদাতা, পালনকর্তা, একমাত্র উপাস্য। তিনি ছাড়া উপাস্য নেই। আমাদের ইহ জীবনের সুন্দরতম সর্বকালের সর্বোত্তম আদর্শ সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র প্রেরিত সর্বশেষ রাসুল, তাঁরই উপাসনাকারী বান্দাহ্।
মাহে মুহাররম অতিবাহিত, মাহে সফর সমাগত। একের পর এক আগত ও বিগত মাসগুলো আমাদের জীবনযাত্রার মাইলফলক’র মত। যেগুলো বারে বারে মনে করিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সমাগত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে, শেষ হয়ে আসছে ইহজীবনের এ যাত্রা। কুরআনে করীম-এ মৃত্যুর কথা ‘জীবন’র আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা মূলক’র প্রথমেই আছে বরকতময় সে সত্তা। যাঁর কুদরতের কব্জায় রয়েছে সৃষ্টিজোড়া রাজত্ব। আর তিনি সর্বোপরি ক্ষমতাবান। যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, এ উদ্দেশ্যে যে, তিনি তোমাদের পরীক্ষা করে দেখবেন, তোমাদের মধ্যে কে সুন্দরতম আমলকারী। তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।’ (৬৭:১-২) বলা যেতে পারে, মৃত্যুর অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য জীবনের সৃষ্টি। এ জীবন ভঙ্গুর, ক্ষণস্থায়ী। তবে মানবজীবন অর্থহীন নয়। পরকালে ইহ-জীবনের কর্মময় জীবনের অনুপুঙ্খ হিসাব নেয়া হবে। সে কর্ম ভালো হোক বা মন্দ-তার সমুচিৎ পুরস্কার বা শাস্তিও বান্দাকে গ্রহণ করতে হবে। আমরা যতই সুখে বা দুঃখে, আনন্দে বা কষ্টে থাকিনা কেন, এ পৃথিবীর সমুদয় মায়া কাটিয়ে আমাদেরকে যেতেই হবে। যে দেশ আমাদের অজানা, অচেনা- সেখানেই আমাদের যেতে হবে। যেতে যত কষ্টই লাগুক, ক্ষণস্থায়ী জীবনের মায়া আমাদের কাটাতেই হবে। পবিত্র কুরআনে, নবীজির হাদীসে কথাটি বারবার ফিরে ফিরে আসছে। জগৎ সংসারের এক বিচিত্র ব্যাপার এটাই যে, জাগতিক জীবনে আমাদের যদি স্থানান্তরে যাত্রা করার প্রয়োজন হয়, তখন সাময়িক গন্তব্যে গমনের জন্য আমরা সাধ্যমত আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার পর্যাপ্ত, রসদসহ ভ্রমণের সবকিছু প্রস্তুতি যোগাড় ও নিশ্চয়তা সম্পর্কে বারবার অবহিত হতে চেষ্টা করি। পরিবহন, অবস্থান কোনটি সহজতর ও স্বচ্ছন্দ হবে, তা নিশ্চিত হই। অনেকে ভ্রমণকালীন পথঘাট চেনা ও সময় বাঁচানোর জন্য গাঁটের অধিক পয়সা খরচ করে গাইডও যোগাড় করি। পার্থিব জীবনের এসব ভ্রমণ প্রয়োজনে পরিবর্তন হতে পারে, বা কর্মসূচি বাতিলও হতে পারে। অথচ পরযাত্রার দিন তারিখ, সময়সূচি অনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও সফর যে সুনিশ্চিত, তা অস্বীকার করি না আমরা কেউই। কিন্তু না ফেরার দেশে নিশ্চিত যাত্রার কথায় দৃঢ় বিশ্বাস রেখেও তার জন্য যথার্থ প্রস্তুতির কথা দূরে, স্মরণ করে সতর্ক থাকার জন্য আমাদের কয় শতাংশ মনোযোগী বা যতœবান? ভাবি, সে পরিসংখ্যান’র প্রয়োজনই বা কী? হয়তো এ কথা বলার কারণে কর্মজীবী ব্যস্ত লোকের অনেকেই আমার জন্য ‘হাঁদা, মধু জাতীয় কোন বিশেষণের মালা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। যতই সুখে আমাদের সময় কাটুক, মৃত্যু আমাদেরকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে, এই ধ্রুব ও মহাসত্যকে আমরা ভুলে যাবো কেন? আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনে বচন-ভিন্নতায় একথাটি আমাদের জন্য কতবার উল্লেখ করেছেন। তাগাদার জন্য এ পুনরুক্তি। তাহলে ভুলে থাকায় কৃতিত্ব কী?
পবিত্র কুরআনের অমোঘ বাণী আরেকটি শুনি? মহান ¯্রষ্টা, যাঁর ইচ্ছায় আমাদের জীবনÑমৃত্যু, তিনি বলেন, ‘যেখানেই তোমরা থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে নাগালে পাবেইÑযদিও তোমরা মজবুত কেল্লার ভেতরেও অবস্থান করো কেন [৪:৭৮] মুসলিম সম্প্রদায়ের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার প্রত্যেকেই এ আয়াত শুধু জানেন, তা-ই নয়; বরং কথায় কথায় আওড়ানও। তা হলো, ‘কুল্লু নাফসিন যা-য়িক্বাতুল মাওত’। অর্থাৎ প্রাণিমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী। পবিত্র কুরআন মজীদে এ বাণী বারংবার উচ্চারিত হয়েছে। তবুও অনাকাক্সিক্ষতভাবেই আমরা তা বেমালুম ভুলে থাকি। সব কথা ভুলে থাকাই কি নিরাপদ, বা বুদ্ধিমানের কাজ? সুরা নিসার ৭৮তম যে আয়াতটির (আংশিক) তর্জমা উদ্ধৃত হয়েছে, সেটার শেষ দিকে উপসংহকারধর্মী অংশে বলা হয়েছে, ‘ফলত সে সম্প্রদায়গুলোর কী পরিণতি হবে, যারা কোন কথাই অনুধাবনের চেষ্টা করে না?’ যতোই আমরা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে, আরামে-আয়েশে কালাতিপাত করি না কেন, ইহজীবনের সংক্ষিপ্ত সময়কাল যে দ্রুত ফুরিয়ে যায়। উল্লেখিত প্রসঙ্গেরও কিছু আগের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক। হিজরতের পূর্বে সম্প্রদায়গত শত্রু কর্তৃক অমানুষিক নির্যাতনের প্রেক্ষিতে মক্কার কিছু বিক্ষুব্ধমনা মুসলমান বলাবলি করেছিল, ‘মুসলমানরা এ নির্যাতনের প্রেক্ষিতে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ কেন হচ্ছে না? তারাই আবার হিজরতের পর শান্তির পরিবেশে মদীনা শরীফে অবস্থানকালে জিহাদের নির্দেশ অবতীর্ণ হওয়ায় বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা কামনা করছিল, এখন এ নির্দেশ না এসে আর কিছুদিন এ অবকাশ বিলম্বিত হতে পারত না! আল্লাহ্র ইরশাদ, ‘দুনিয়ার ভোগÑবিলাস খুব অল্প; মুত্তাক্বীদের জন্য আখেরাত’র (পুরস্কার)ই উত্তম।’ বাস্তবিকপক্ষে আমাদের আয়ু আরো স্বল্প। যা ভোগ করার তীব্র বাসনায় আমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের অবাধ্য হয়ে চলছি প্রতিনিয়ত। দিনÑরাত মিছে মরীচিকার পিছনে হন্যে হয়ে ছুটছি। জানি না, আদৌ আমাদের বোধোদয় হবে কিনা।
শেষ যমানা বড়ই দুঃসহ। মানুষের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাবে বিভীষিকাজনক হারে। অহঙ্কার প্রদর্শনের প্রক্রিয়া হবে জঘন্যতম অপরাধ বৃদ্ধির ভয়াবহ রূপ। সমাজের মান্যবর ব্যক্তিবর্গ জড়িয়ে পড়বেন ঘৃণ্য সব অপরাধে। যারা শাসন করবে, বারণ করবে, যারা উপদেশ দেবে তাদের মাঝেই সংক্রমিত হবে অপরাধের ভাইরাস। অনেককাল আগেই উসওয়ায়ে হাসানা’র প্রতিবিম্ব, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, অদৃশ্যজ্ঞানের ধারক নবী, রাসূলে করীম (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার উম্মতের নিকট এমন এক সময় আসবে, যখন তাদের অন্তরগুলো হবে বাঘের (অন্তরের) মত, তাদের (বাহ্যিক মুখের) কথা হবে নবীদের বাণীর মত (মধুর বচনে সদুপদেশ), আর তাদের কার্যকলাপ হবে ফিরআউনের মত’। (অর্থাৎ নির্দয়, নির্মম, অবলীলায় পাখির মত গণহত্যা, নির্বিচারে ভালো মানুষদের জানÑমাল ধ্বংস করা ইত্যাদি)।
সমাজের গণ্যমান্য অনুসরণযোগ্য শ্রেণির মানুষগুলোর চরিত্র হবে ভয়াবহ। তাদের জন্য আল্লাহ্র রাসূল জাহান্নামের শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি (দ.) ইরশাদ করেন, ‘তিন শ্রেণির লোক জাহান্নামে যাবে। ১. জালিম শাসক (সাধারণ প্রজার যাঁরা নিরাপত্তার যিম্মাদার), ২. মিথ্যুক আলেম, (নিজেদের রুটি-রুজির জন্য যারা ধর্মের মিথ্যা অপব্যাখ্যা দেবে, ৩. ব্যভিচারী বৃদ্ধ (বয়সে ও যাদের সুমতি আসে না)। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাদ্বি.) বর্ণিত রাসুলাল্লার্হ আর একটি অমীয় বাণী উল্লেখ করতঃ আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানা হবে। তিনি ইরশাদ করেন, ছয় শ্রেণির মানুষের প্রতি আমি অভিসম্পাত দেই, আল্লাহ ও তাদের প্রতি অভিসম্পাত দিয়েছেন। ১. যে ব্যক্তি আল্লাহ্র কিতাবে নিজ থেকে কিছু যোগ করে, ২. যে তাকদীর অস্বীকার করে, ৩. যে জোর পূর্বক মুসলমানদের নেতৃত্ব দখল করে, যাকে আল্লাহ লাঞ্ছিত করেছে, তাকে সে সম্মানের আসনে সমাসীন, আর তিনি যাঁকে সম্মানিত করেন সে তাঁকে লাঞ্ছিত করে, (এর উদাহরণ ইয়াযীদ), ৪. যে আল্লাহর কৃত হারামকে হালাল জানে (অর্থাৎ মক্কার হেরমে খুনÑখারাবি ও শিকার করে), ৫. যে আমার বংশধর ও সন্তানÑসন্ততির মান হানি করে, ৬. যে আমার সুন্নাতকে পরিত্যাগ করে। (মেশকাত শরীফ দ্র:) স্বল্প এ জীবনে ভোগের লিপ্সা বর্জনীয়।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব :হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।