হুমাইরা তাজরিন
‘সাঁতাও’ যার অর্থ টানা বর্ষণ। টানা বর্ষণ বা অতি বৃষ্টি এবং অনাবৃষ্টির সমস্যায় জর্জরিত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো। কখনও ফসলের মাঠ, কখনও বাড়িঘর , কখনওবা সমস্ত জেলাটাই বন্যায় প্লাবিত হয়। এর মাঝেই যেন চলছে প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জীবন। যেখানে প্রকৃতি ও জীবনের উপর্যুপরি আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন মানুষ। উপর্যুপরি আঘাতে তাদের জর্জরিত জীবনের ছবি ‘সাঁতাও’ নির্মাণ করেছেন নির্মাতা খন্দকার সুমন। সিনেমাটি চট্টগ্রামের সিনেমা হলগুলোতে গতকাল প্রিমিয়ার শো করা হয়েছে। একযোগে সপ্তাহব্যাপী চলবে সুগন্ধা সিনেমা হল ও সিলভার স্ক্রিন সিনেপ্লেক্সে।
নগরীর সিলভার স্ক্রিন সিনেপ্লেক্সে সিনেমাটি দেখতে এসে রায়হান রফিক নামের একজন দর্শক জানান, ‘আসলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ দর্শক বাণিজ্যিক ছবিগুলো দেখে। কিন্তু সাঁতাওয়ের মতো সিনেমাগুলোতে মানুষের কথা বলা হয়। স্টোরি, দৃশ্যায়ন, মুখ্য চরিত্রগুলোতে পুতুল আর ফজলুল হকের অভিনয় অনবদ্য। যদিও তারা এখনও জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে তাদের অভিনয় অনেক বেশি পরিণত। আর খন্দকার সুমনকে শক্তিশালী নির্মাতা মানতে হবে। সিনেমার ভিতরে বাইরে সংগ্রাম করেছেন। পুরো সিনেমাটিতে পারিপার্শি¦কতার প্রভাব উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনে কিভাবে প্রভাব ফেলে সেটি তাদের সারল্যকে অক্ষুণ্ন রেখে ধারাবাহিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতা ‘সাঁতাও’ এর মতো সিনেমাতে। এসব সিনেমা না দেখলে সমাজ, রাষ্ট্র , জীবন সম্পর্কে যথাযথ বোধ আমাদের সৃষ্টি হবেনা। বিনোদনের সাথে বোধের সম্পর্কটাও আমরা ভুলতে বসবো।’
মুমতাহিনা বিনতে মোমিন নামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক দর্শক বলেন,‘ সিনেমাটিতে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামী জীবন ছাড়াও তাদের যে মিষ্টি একটা ভাষা, লোকঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপাদানগুলো ফুটে উঠেছে সেগুলোও আমার বেশ ভালো লেগেছে। যেমন নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা, পিঠার মৌসুম, বিয়ে ও সন্তান সম্ভাবা নারীর ৭ মাসের অনুষ্ঠানে গাওয়া লোকগান তার সাথে নাচ। অভিনেতাদের অভিনয়ও অসাধারণ। তাদের ইমোশনাল সিনগুলো অনেক বেশি রিয়েলিস্টিক মনে হয়েছে। সিনেমাটা আমাকে অনেক বেশি ছুঁয়ে গেছে।’
গণ-অর্থায়নে তৈরি রংপুর অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংকটের সিনেমা ‘সাঁতাও’ সম্পর্কে নির্মাতা খন্দকার সুমন বলেন,‘ আমার মাথায় অনেকগুলো ছবি ছিলো যেগুলো দিনে দিনে যুক্ত হয়ে একটা পূর্ণর্দৈঘ্য সিনেমার রূপ নিয়েছে। তবে কোনোটি অপ্রাসঙ্গিক নয়। আমি কখনও ভাবিনি আমি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরি করবো। কিছু ছবি মানুষকে আরাম দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে আবার কিছু ছবি আছে চিন্তার ছবি যেগুলো মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে। সুতরাং ঘুমানো এবং জেগে উঠা দুটোই দরকার। তাই আমাদের দুই ধরনের সিনেমাই নির্মাণ করতে হবে। চট্টগ্রামের দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলবো, চট্টগ্রামের মানুষ নিজের শেকড়কে খুব ভালোবাসে। কোনো পরিবর্তন তাদের এই শেকড় প্রীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। যেটা আমি পর্যবেক্ষণ করলাম। তাই তারা অন্যের শেকড়কেও সম্মান করে। আর অন্যের শেকড়কে সম্মান করে বলেই তারা ‘সাঁতাও’ দেখবে। কারণ ‘সাঁতাও’ শেকড়ের কথা বলে।’
সিনেমাটি পরিচালনা ছাড়াও সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন খন্দকার সুমন। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন রানওয়ে খ্যাত অভিনেতা ফজুলল হক এবং আইনুন পুতুল।
এছাড়া বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাবেরা ইয়াসমীন , স্বাক্ষ্য শাহীদ, শ্রাবণী দাস, তাসমিয়া শিমু, মিতু সরকার, পারুক শিয়ার , আফরিনা বুলবুল, রুবল রোদী, আলমগীর কবীর,রবি দেওয়ান,দীনবন্ধু পাল।
প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে ছিলেন শ্যামল শিশির। সহকারী পরিচালক মাসদি রানা ও সুপিণ বর্মণ।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রংপুর, লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পাড়ে সিনেমাটির দৃশ্য ধারণ শুরু হয় এবং লালমনিরহাটের চর গোকুণ্ডা গ্রামে এর বেশির ভাগ দৃশ্য ধারণ করা হয়, যেটি তিস্তার ভাঙনে গত বছর নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে।
নগরীর সিলভার স্ক্রিন সিনেপ্লেক্সের অপারেশন ম্যানেজার সালাউদ্দিন পারভেজ বলেন, ‘সিনেমাটি এবং এর মুক্তি সম্পর্কে এখনও চট্টগ্রামের মানুষ জেনে উঠেনি। তারপরও যারা জীবন নির্ভর এসব সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন তাদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এছাড়া যারা দেখে বের হচ্ছেন তারাও সন্তুষ্ট বলে জানাচ্ছেন। আশা করি ‘সাঁতাও’ তার কাক্সিক্ষত সাফল্য পাবে। যারা এখনও দেখেননি তারা হলে এসে সিনেমাটি দেখবেন।’