সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন কি সম্ভব?

কামরুল হাসান বাদল »

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন সফল পরিণতি লাভ করে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার সরকারি স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

এরপর থেকে যে দাবিটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে তা হলো সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের। স্বাধীনতার পর এই দাবি আরও বেশি প্রবল হয়েছে। এখনও ফেব্রুয়ারি মাস এলে বিভিন্ন মহল থেকে একই দাবি উচ্চারিত হয়ে থাকে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে জোরালো কিছু পদক্ষেপ নেন। এরমধ্যে অন্যতম হলো বাংলায় সংবিধান প্রণয়ন করা। বিজয়ের মাত্র দশ মাসের মাথায় তিনি বাঙালির প্রথম সংবিধান বাংলায় রচনা করেছিলেন। সে সংবিধানের একটি ইংরেজি ভার্সন থাকলেও কোনো বিষয়ে অর্থগত পার্থক্য দেখা দিলে সেখানে বাংলায় যে ব্যাখ্যা আছে তাকেই প্রণিধানযোগ্য বলে স্পষ্ট করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই তিনি ব্যাংকগুলোকে পুনর্বিন্যাস করে বাংলায় নামকরণ করেন। সোনালী ব্যাংক, রুপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক ইত্যাদি। তেল কোম্পানিগুলোর নাম করেন, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদি। এভাবে তিনি বাংলায় নামকরণ ও বাংলা প্রচলনের উদ্যোগ নেন।

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য পৃথিবীর সব দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারে বাংলা ভাষার কথা, জানতে পারে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি জাতির একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ আছে, তার নাম বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু এদিন ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমাদের এই অঙ্গীকারের সাথে শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবে।’

এতকিছুর পরও কিন্তু এ দেশে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবিটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই ইংরেজিসহ কিছু ভাষার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে প্রিয় বাংলা ভাষা। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও আধুনিক প্রযুক্তিসম্বলিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খপ্পরে পড়ে এ ভাষা ক্ষীণতার মুখে পড়েছে।

বর্তমান সময়ে আমাদের সবকিছুতে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। শিক্ষা, গবেষণা, ব্যবসা, তথ্যবিনিময় এমনকি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রেও আমাদের ভাবতে হচ্ছে আন্তর্জাতিকতার বিষয় মাথা রেখে। ফলে এখন ইচ্ছে করলেও অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক গ্রহণীয় ইংরেজিভাষাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

উচ্চশিক্ষাসহ চিকিৎসা ও প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলায়নের ক্ষেত্র আগের চেয়ে অনেক প্রশস্ত হয়েছে। তবে বাংলাভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে ছিল দেশের আদালতসমূহ। তবে আশার কথা হচ্ছে সে ক্ষেত্রেও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন শুরু হয়েছে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পর এদিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ও হাইকোর্ট বিভাগের তিনটি দ্বৈত বেঞ্চ বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। একইদিন ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটের ‘বাংলা সংস্করণ’-ও উদ্বোধন করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম প্রায় দেড় শ মামলায় বাংলায় আদেশ ও সিদ্ধান্ত প্রদানকালে বলেছেন, এখন থেকে বাংলা ভাষায় আদেশ দেওয়া হবে।

সঙ্গত কারণে উল্লেখ করতে হয় যে, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ ইতিপূর্বে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ দিলেও আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির বাংলায় আদেশ প্রদান দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথম। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ ইতিপূর্বে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। তবে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির বাংলায় আদেশ প্রদান দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথম। এ দিনের প্রথমার্ধে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক মামলায় বাংলায় রায় দেন। ‘মো. আক্কাস আলী বনাম বাংলাদেশ’ শিরোনামে অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার আগে বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেন, ‘আজ ভাষার মাস শুরু হচ্ছে। ভাষাশহিদের আত্মার প্রতি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতি সম্মান জানিয়ে আজ প্রথম রায়টি বাংলায় ঘোষণা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ১৩ বছরের বিচারিক জীবনে প্রথম বাংলা ভাষায় রায় দিলাম। বাংলায় এই রায় দিতে পেরে গর্ববোধ হচ্ছে। ভাষার মাসে বাংলা ভাষায় আরও রায় দেব।

এদিন মধ্যাহ্নবিরতির পর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ উল্লেখ করেন, ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি মামলায় বাংলায় রায় ঘোষণা করবেন। এরপর একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায় রায় ঘোষণা করেন এই দ্বৈত বেঞ্চ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, প্রয়াত বিচারপতি এ আর এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হাইকোর্টে বাংলায় আদেশ দেওয়া শুরু করেন। এরপর সাবেক বিচারপতিদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দেন। বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, চার নদী সংরক্ষণসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় বাংলায় দেন।

আগেও উল্লেখ করেছি, বৈশ্বিক কারণে শুধু আমরা নই বিশ্বের অনেক দেশ, অনেক জাতিকে নিজের ভাষার চেয়ে ইংরেজির ওপর গুরুত্ব বেশি দিতে হচ্ছে। ফ্রান্স, চীন, জাপানের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো যারা আগে নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে চাইতো না জাত্যাভিমানের কারণে তারাও এখন অনেক ক্ষেত্রে আপোষ করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে তারা এখনো পারতপক্ষে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে চায় না। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বলে ফ্রান্স, জাপান, চীনের মতো দেশগুলোর পক্ষে ইংরেজি ভাষাকে উপেক্ষা করা সহজ হলেও আমাদের মতো দেশের পক্ষে তা সম্ভব নয় কারণ আমাদের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হলে অবশ্যই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে মেনে নিতে হবে, ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান ভারতে শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি ও অর্থনীতির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা রাজ্য কেরালার উদাহরণ টানতে পারি।

তবে হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা, তা হলো আমাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। এ দুটোর পরীক্ষায় যদি আমরা পাশ করতে পারি তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি ঠিক রেখে আন্তর্জাতিকতাকে মোকাবিলা করার জন্যই শুধু নিজেকে প্রস্তুত করা। নিজেকে সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তু করে নয়।

এখানে নিজেদেরও একটু স্বচ্ছ হওয়া দরকার। সবকিছু বাংলায় লিখতে যখন বলছি, সবকিছু বাংলায় নামকরণের দাবি যখন জানাচ্ছি তখন কি একবারও ভাবছি যে আমাদের নিজেদের নামটিও বাংলায় কিনা?