নিজস্ব প্রতিবেদক »
রমজানকে ঘিরে সরকারের তরফ থেকে ২৯ পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও ওই দরে মিলছে না নিত্যপণ্য। এসব পণ্যের দর নির্ধারণ শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ এবং বাজার তদারকিতে অবহেলা রয়েছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী ক্রেতারা।
বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর অন্যতম ভোগ্যপণ্যের বাজার রেয়াজউদ্দিন ও খাতুনগঞ্জে ঘুরে দেখা যায়, রমজান ঘিরে ডাল, ছোলা, তেল, চিনি, খেজুর, শুকনো মরিচ, আলু, মাংসসহ ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণের প্রায় ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও খুচরা পর্যায়ে একটি পণ্যের দামও নির্ধারিত দরে বিক্রি হচ্ছে না। এমনকি খেজুর, ছোলা, ডালের মতো রমজানের অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি পাইকারি বাজারে।
গত ১৫ মার্চ সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর আগে খেজুরের বাজার নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাজারে পণ্যের দরে এমন অরাজকতাকে ভুক্তভোগী ক্রেতারা দায়ী করছেন খুচরা বিক্রেতাসহ বাজার তদারকিতে অবহেলাকে, আর খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করছেন পাইকারদের কারসাজিকে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, সরকার পেঁয়াজের দাম ৬৫ টাকা কেজি দরে বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে সেই দরের ধারে কাছেও নেই পণ্যটি। সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে ৭০ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। গরুর মাংস ভোক্তা বা খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ৬৬৪ টাকা ও খাসির মাংস ১০০৩ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা কোন বাজারেই এই দরে বিক্রি করছেন না। খুচরা পর্যায়ে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭৫০ থেকে ৯৫০ টাকা আর খাসির মাংস বিক্রি করছে ১ হাজার ১১৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজি ধরা হয়েছে ১৭৫ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৬২ টাকা। কিন্তু বাজারে সেই দরে পাওয়া যায়নি। বাজারে ব্রয়লার বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা ও সোনালি ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা কেজিতে। আর নির্ধারণ করে দেওয়া ৩২৭ টাকার শুকনো মরিচ খুচরা বাজার তো দূরের কথা, খাতুনগঞ্জের আড়তেই বিক্রি হচ্ছে ৪২০ থেকে ৪৭০ টাকা কেজিতে।
সরকারের নির্ধারিত দরে মাংস কেনা যাচ্ছে কি’না জানতে চাইলে রেয়াজউদ্দিন বাজারে গরুর মাংস কিনতে আসা মো. জাবেদ চৌধুরী বলেন, ‘সরকার মাংসের দর নির্ধারণ করছে জানলেও আমরা কি করবো? চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে কখন ৬৬৪ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ভুলে গিয়েছি। প্রশাসনের মন ভুলানো গল্প ছাড়া আর কিছু না। সাড়ে ৯০০ টাকার নিচে কোন গরুর মাংসই বিক্রি হয় না। আর ৭০০ যেসব বিক্রি হয় তা বাসি আর হাড় মিশিয়ে দেযা। গরুর হাড় বিক্রি করে ৭৫০ টাকা কেজি, মাংস না।’
এদিকে পেঁয়াজ ও মাংস বিক্রেতাদের দাবি, তারা সরকারের নির্ধারিত দরে পেঁয়াজ ও মুরগি পাইকারি পর্যায়ে কিনতে পারছে না। ফলে তাদের পক্ষে ওই দরে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
রেয়াজউদ্দিন বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. মাইনুল বলেন, সরকার ৬৫ টাকা পেঁয়াজের দর নির্ধারণ করে দিলেও আড়তে বিক্রি করছে ৭০ টাকা। তাহলে আমরা কিভাবে ৬৫ টাকায় বিক্রি করবো?
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মুদি পণ্যের দামও বেঁধে দিয়েছে। মুগ ডালের দাম ১৬৫ ও মাষকলাই ডাল ১৬৬ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে ১৮০ ও ১৭০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। আমদানি করা ছোলা ৯৮ টাকা বললেও রমজানের শেষ পর্যায়ে এসেও বাজারে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে। উন্নত মসুর ডাল ১৩০ টাকা ও মোটা মসুর ডাল ১০৫ টাকা বললেও খুচরা বিক্রেতারা ১৩৫ ও ১১০ টাকার কম বিক্রি করছেন না। খেসারির ডাল ৯৩ টাকা হলেও রেয়াজউদ্দিন বাজারে ১২০ ও বকসিরহাট বাজারে ১৪০ টাকা। ১২১ টাকার বেসন ১৩০ টাকা, ১০ টাকা ৪৯ পয়সার ডিম ১০ টাকা ৮৮ পয়সা পিস, ৬০ টাকার চিড়া ৮০ টাকায় ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে।
বকসিরহাটে মুদির বাজার করতে আসা ক্রেতা মো. এসএম ইসতিয়াক বলেন, ‘সরকার প্রতিবছরই নিত্যপণ্যের দর নির্ধারণ করে দেয়। কোন বছরই অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব নিয়ম মানে না। দর নির্ধারণ কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। আমরা ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি। প্রশাসন চোখে দেখলে নীরব থাকলে আমরা সাধারণ জনগণ কি করবো।’
সবজির বাজার ঘুরে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব সবজির দর স্থিতিতে থাকলেও কিছুটা চড়া আলু ও কাঁচা মরিচের বাজার। তবে এ দুটি পণ্যও সরকারের নির্ধারিত দরে বিক্রি করছে না। সরকারের পক্ষ থেকে কাঁচা মরিচের কেজি ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বকসিরহাট বাজারে বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। আর ২৮ টাকার নির্ধারিত আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। তাছাড়া বেঁধে দেওয়া ২৮ টাকা কেজির বাঁধাকপি বাজারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, ২৯ টাকার ফুলকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। ৫০ টাকার বেগুন ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ৪৮ টাকার শিম ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ৪০ টাকার টমেটো ৬০ থেকে ৮০ টাকা, ২৪ টাকা কেজির মিষ্টিকুমড়া ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কিছুটা স্থিতিতে রয়েছে ডিমের বাজার। প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২৫ টাকায়।
কমেনি খেজুরের দাম
এদিকে রমজানকে ঘিরে কয়েক মাস থেকেই খেজুরের বাজারে চরমভাবে নৈরাজ্য চলতে থাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিম্নমানের খেজুরের দাম ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং অতি পরিচিত জাহিদি খেজুর ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এরপর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকেও আমদানি করা জাহিদি খেজুরের দাম ১৮৫ টাকা কেজি বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বাজার ঘুরে দেখা যায় অতি নিম্ন মানের খেজুরই বিক্রি হয়েছে ২৩০ থেকে ২৮০ টাকা। আর জাহেদি খেজুর ৩২০ থেকে ৩৬০ টাকা। তাছাড়া মানভেদে উন্নত মানের খেজুর কেজিপ্রতি ৬০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বাজারে পর্যাপ্ত খেজুর থাকলেও সে অনুযায়ী ক্রেতাদের চাহিদা কম।
ক্রেতা মো. সিরাজ উদ্দিন বলেন, খেজুরের চাহিদা থাকে রমজানের শুরুতে, বর্তমানে ক্রেতাদের আগ্রহ তেমন নেই। কারণ গ্রীষ্মের অন্যান্য ফলে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে।
চড়া দামে স্থিতিতে মাছ
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে চড়া দরের মধ্যে স্থিতিতে রয়েছে মাছের বাজার। ২৫০ টাকার নিচে কোন মাছই বাজারে মিলছে না। বাজারে রুই-কাতলা-মৃগেল, কার্পিও, পাবদা, সরপুঁটি, চিতল মাছ বিক্রি হয়েছে সাইজভেদে ২৮০ থেকে ৪০০ টাকা। আর সমুদ্রের রুপচাঁন্দা, আঁইড়, লাক্ষা ৪৫০ থেকে ৭০০ টাকা। কৈ, শিং, মাগুর ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা ও চিংড়ি ১ হাজার ১০০ টাকা উপরে।
বকসির হাটের মাছ ব্যবসায়ী অনিক দাশ বলেন, রমজানে মাছের চাহিদা বাড়ায় যোগান সংকট রয়েছে, যার কারণে আড়ত পর্যায়ে মাছের দাম বাড়তির দিকে।
অন্যদিকে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, বাজার তদারকিতে ভোক্তা অধিকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের অবহেলা নেই। ভোক্তাদের স্বার্থে আমরা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছি। সঠিক প্রমাণাদির ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থাও নিচ্ছি।