সমাজ

মুহিতুল ইসলাম মুন্না »

গ্রামের পাশের বিশাল বটগাছটির নিচে প্রতিদিনই মানুষজনের আসর বসে। এখানে বয়স্ক থেকে শুরু করে ছোট বাচ্চারাও আসে। আজ সন্ধ্যেতেও সেই জমায়েত। আলোচনার বিষয় সমাজের রীতিনীতি আর মানুষের আচরণ। কথা বলছিলেন গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি হারু চাচা। পাকা শীর্ণ চেহারা আর অমলিন চেহারায় মায়ার এক ধরনের নরম পরশ।
হারু চাচা কথা শুরু করলেন, ‘শোনো বাবা, আমরা বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শিখেছি সমাজ মানে একটা বড় পরিবার। এখানে ভালো-মন্দ সবই একসাথে ভাগাভাগি করতে হয়।’
গা ঘেঁষে বসে থাকা মেহের আলী জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু হারু চাচা, কেবল কি ভালো-মন্দ ভাগাভাগি করলেই সমাজ টিকে থাকবে?’হারু চাচা মাথা নেড়ে বললেন, ‘না বাবা, সমাজ টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। ভালোকে ভালো বলার সাহস আর খারাপকে খারাপ বলার যোগ্যতা থাকতে হবে।’ পাশ থেকে উঠল রফিক, গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে, ‘চাচা, আপনি বলছেন মানসিকতা পরিবর্তনের কথা। কিন্তু আমরা কি সত্যিই সমাজ বদলাতে পারব? মানুষ তো শুধু নিজের স্বার্থে চলছে!’হারু চাচা নীরব থেকে এক গাঢ নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘সমাজ বদলানো খুব কঠিন কিছু নয় রে বাবা। কিন্তু সেটা করতে হলে প্রথমে নিজেকে বদলাতে হবে। নিজের মধ্যে সততা আর ন্যায়বোধ আনতে হবে। এরপরেই সমাজ পরিবর্তন আসবে।’
আলোচনার এই সময়ে পাশের বসা ছোট্ট ছেলেটা, রমিজ, মাটির দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে কিছু একটা আঁকছিল। হঠাৎ সে মুখ তুলে বলল, ‘চাচা, মানুষ যদি একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসে আর খারাপ কিছু না ভাবে, তাহলে কি সমাজটা সুন্দর হবে?’
হারু চাচার চোখ চকচক করে উঠল। তিনি মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ রে ছোট্ট, তুই ঠিকই বলেছিস। সমাজ বদলানোর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ভালোবাসা। আমরা যদি সবাই একে অপরের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এগোতে পারি, তাহলে সমাজটা নিজের মতোই বদলে যাবে।’সমস্ত মানুষের মুখে তখন মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। মনে হলো, সমাজ বদলের বীজটা তাদের মনের ভেতরেই জন্ম নিয়েছে। হারু চাচার কথা শুনে সবাই গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ল। এত সহজ কথায় এত গভীর উপলব্ধি, কেউ যেন ভাবতেই পারেনি। তবে মেহের আলী আবার প্রশ্ন তুলল, ‘চাচা, আমরা তো চাই ভালো কিছু করতে। কিন্তু যতবার চেষ্টা করি, ততবার সমাজের লোকেরা টেনে ধরে। তারা বলে যে এটা আমাদের ঐতিহ্য, এটা আমাদের নিয়ম।’
হারু চাচা একটু হেসে বললেন, ‘এই সমাজের নিয়ম আর ঐতিহ্য আমরা কাদের জন্য করছি বল তো? নিজেদের সুখের জন্য, মানুষের ভালোবাসা আর সম্মানের জন্যই তো! কিন্তু আমাদের কাজগুলো যদি মানুষের ক্ষতি করে, তাহলে কি সেটা আসলেই ভালো ঐতিহ্য?’রফিক তখন উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ‘চাচা, আপনার কথাগুলো খুব সত্যি। কিন্তু সমাজের একটা বড় অংশ এখনো নিজেদের বদলাতে চায় না। সবাই নিজের সুবিধাটুকু ধরে রাখতে চায়। যে কারণে সমাজটা আজ অনেকাংশে অন্যায়, অসাম্য আর হিংসায় ভরে গেছে।’হারু চাচা মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তুই ঠিকই বলেছিস। কিন্তু একবার ভাব, যদি তুই নিজের ছোট্ট পরিবার থেকে শুরু করিস, নিজের বাচ্চাদের ন্যায় আর সত্যের পথে চলতে শেখাস, তাহলে তোর সেই চেষ্টা থেকে অন্যরাও একদিন শিখবে। সমাজ একা একজন বদলাতে পারবে না; কিন্তু অনেক মানুষ যখন একই সাথে বদলাবে, তখনই সমাজের মধ্যে একটা পরিবর্তনের ঢেউ আসবে।’আলোচনা শুনতে শুনতে পাশ থেকে উঠে আসল গ্রাম্য চিকিৎসক মজনু ডাক্তার। তিনি একটু হেসে বললেন, ‘চাচা, আমি দেখছি, আপনি শুধু কথায় নয়, কাজে সত্যিই সমাজ বদলানোর চেষ্টা করছেন। আপনি যেভাবে প্রতিদিন সবাইকে এখানে আসতে বলেন, সবার কথা শোনেন, এটা ছোট কাজ মনে হলেও আসলে বিশাল এক অবদান।’
হারু চাচা মৃদু হেসে বললেন, ‘বাবা, আমিও তো এই সমাজেরই একজন। আর সমাজ আমাদের প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছে। আমি যা শিখেছি, সেটা তো আমি সমাজ থেকেই পেয়েছি। তাই আমিও সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই। আমরা যদি সবাই নিজেদের সামান্য সামান্য ভালোটুকু দিয়ে সমাজকে সাজাই, তবে বড় পরিবর্তন আসবে।
একসময় সবাই ভালো কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবে।’
আলোচনার শেষে সবাই কিছুটা শান্ত হয়ে গেল। সেই ছোট্ট রমিজ, যার প্রশ্নে এত বড় আলোচনা শুরু হয়েছিল, আবার মাটিতে আঁকতে ব্যস্ত। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘কিরে, কী আঁকছিস?”রমিজ মাথা তুলে মিষ্টি হেসে বলল, ‘আমি একটা নতুন সমাজ আঁকছি। যেখানে সবাই সবার বন্ধু, কেউ কারো ক্ষতি করতে চায় না। সবাই মিলে বটগাছের নিচে বসে গল্প করে, যেমন আমরা এখন করছি।’
বটগাছের ছায়ায় হারু চাচা তার ছোট্ট হাতখানি ধরে বললেন, ‘তোর আঁকা সমাজটাই একদিন বাস্তব হবে রে বাবা। যদি আমরা সবাই এভাবে মন খুলে ভালোবাসতে পারি।’
হারু চাচার সেই মমতার হাত ছুঁয়ে রমিজ যেন পৃথিবীর সব সুখ পেয়ে গেল। অন্যরাও মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। আর সবাই মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করল যে সমাজে সত্য, ভালোবাসা আর সহানুভূতির মূল্য থাকবে, সেই সমাজ গড়তে তারা নিজেরাও কিছু না কিছু করবে।