সুজনের গণসাক্ষাৎকারে একদিন
আগামীতে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষের কথা শুনব
ভূঁইয়া নজরুল :
স্ক্রেচারে ভর দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নোমান হোসেন নামের এক যুবক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ভ্যানের মাধ্যমে ফল বিক্রেতা নোমানের আর্তি গত ২০ অক্টোবর স্টেশন রোড এলাকায় সিটি করপোরেশনের আবর্জনাবাহী গাড়ি তাকে আঘাত করে। এতে তার পায়ের চারটি আঙ্গুল ভেঙে যায় এবং চিকিৎসা চালাতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে। তাই সাহায্যের জন্য প্রশাসকের নিকটে এসেছেন। নোমানের মতো গতকাল সকাল ১১টা ৪০ থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত ২৬ জন মানুষ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন।
চসিক আন্দরকিল্লা কার্যালয়ে (পুরাতন অফিস) মেয়রের কক্ষে অনুষ্ঠিত গণসাক্ষাতে আসা প্রত্যেকের আবেদন শুনেছেন, জবাব দিয়েছেন কিংবা সমাধানের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। গতকাল সিটি করপোরেশনের পুরাতন ভবনে (আন্দরকিল্লা) গণসাক্ষাৎকারে উপস্থিত থেকে এসব চিত্র দেখা যায়।
ফলবিক্রেতা নোমান হোসেনকে সিটি করপোরেশনের সমাজকল্যাণ তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা অনুদান হিসেবে দেয়ার জন্য প্রশাসক আবেদনে লিখে দেন। শুধু নোমান হোসেন নন, চান্দগাঁও এলাকায় ট্যাক্স আদায় করতে গিয়ে রাজস্ব বিভাগের তুষার কান্তি দাশ নামের এক উপ কর কর্মকর্তা ২০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছেন বলে অভিযোগ নিয়ে এসেছেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। তার অভিযোগের বিষয়ে খোরশেদ আলম সুজন তুষার কান্তি দাশকে ফোন করলে তুষার কান্তি দাশ ‘কে’ জানতে চান। নিজেকে খোরশেদ আলম সুজন পরিচয় দিয়ে ফোন করার পর কারো কাছে ২০ হাজার টাকা চাওয়ার বিষয়টি জানতে চান। অপর প্রান্ত থেকে হ্যাঁবোধক জবাব আসার পর তাকে শাসান প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ যাতে আর পাওয়া না যায়।’
সিটি করপোরেশনের এক ঠিকাদার তার পাওনা টাকার জন্য এসেছেন প্রশাসকের কাছে। একইসাথে তার ভাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তাই টাকাটা খুব দরকার। তার কথা শুনে খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘ সিটি করপোরেশন আর্থিক সমস্যায় রয়েছে। আমার এখানে তো দেয়ার মতো টাকা নেই। টাকা এলে দেয়া হবে। তবে ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে বলে দেয়া হচ্ছে যাতে চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি না হয়।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কুলগাঁও স্কুল থেকে অবসরে যাওয়া খোরশেদ আলম নামের এক শিক্ষক প্রশাসকের সামনে এসে কান্না শুরু করে দেন। তিনি ২০১৮ সালে চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর ৪২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু এখনো কোনো টাকা পাননি। অর্থের অভাবে খুব কষ্টে আছেন। প্রশাসক তাকে আশ্বস্ত করেন। ক্রমান্বয়ে সবাইকে টাকা দেয়া হচ্ছে এবং উনাকেও দেয়া হবে বলে জানানো হয়। একই কারণে আবদুল মালেক নামের আরেক শিক্ষক তার স্ত্রীকে নিয়ে প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি ২০১৭ সালে চাকরি থেকে অবসরে গেলেও এখনো পর্যন্ত কোনো টাকা পাননি।
প্রশাসক সুজন বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত যারা অবসরে গিয়েছেন তাদেরকে পর্যায়ক্রমে টাকা দেয়া হচ্ছে। করপোরেশনের তহবিলে টাকা না থাকায় দেয়া যাচ্ছে না, তাই টাকা পাওয়া সাপেক্ষে ক্রম অনুসরণ করে দেয়া হবে। আপনাদের আসার দরকার নেই। এমনিতে ব্যাংক হিসেবে টাকা চলে যাবে।
শুলকবহর মহল্লা সমাজ কমিটি বিশাল এক টিম নিয়ে এসেছেন প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে। তাদের দাবি জলাবদ্ধতা নিরসন। বর্তমানে জলাবদ্ধতা প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে নালা ও খালগুলোকে আগের চেয়ে সরু করে ফেলা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে তারা মুক্তি চান। প্রশাসক বলেন, এই প্রকল্পটি সেনাবাহিনী বাস্তবায়ন করছে। তারপরও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীকে বলে দেয়া হচ্ছে, তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন।
আবু তাহের নামে একজন ঠিকাদার পাওনা টাকা চাইতে এসে খোরশেদ আলম সুজনকে ধন্যবাদ জানান। দর্শনার্থীদের একটি নির্ধারিত দিনে ডেকে সম্মেলন কক্ষে বসিয়ে চা নাস্তা খেতে দেয়া এবং পর্যায়ক্রমে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করায় তিনি ধন্যবাদ দেন। এভাবে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নগরবাসী চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
এই পদ্ধতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘আমি প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর নগরবাসী আর আমার মধ্যে কোনো দেয়াল রাখতে চাইনি। তাই নগরবাসীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে এই আয়োজন করেছি। প্রায় ১০ দিন অন্তর এভাবে কথা বলি, তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিই এবং সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করি।’
তিনি আরো বলেন, আগামীতে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা শুনবো এবং সমাধানের চেষ্টা করব।
গণসাক্ষাৎকার নামের এ কর্মসূচি গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম শুরু করে এ পর্যন্ত সাত দফা হয়েছে। প্রতি দফায় ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষ এসে দেখা করেন। কোনো সমস্যায় একজনের নাম নথিভুক্ত করা হলে মহল্লার বিশাল একটি টিম এসে হাজির হন। গণসাক্ষাতের তালিকাপদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়, টাইগারপাস সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ে একটি হেলপ ডেস্ক রয়েছে। সেখানে নাম নথিভুক্ত করতে হয়। তাতে নাম, দেখা করার কারণ এবং মোবাইল নম্বর দিতে হয়। নাম নথিভুক্ত করার এক সপ্তাহের মধ্যে করপোরেশন থেকে জানিয়ে দেয়া হয় কোন দিন ক’টার সময় প্রশাসক সাক্ষাৎ দেবেন। সেই অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের আন্দরকিল্লা ভবনে মেয়রের কক্ষে এ সাক্ষাৎকার কর্মসূচি হয়ে থাকে। সেখানে অভিযোগকারীদের সমস্যা শুনে একান্ত সচিবকে মন্তব্য লিখে নির্দেশনা দেন এবং কখনো সরাসরি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ফোন করে সমাধান করতে বলেন।