এম আব্দুল হালীম বাচ্চু »
হারান মিয়া ভোরবেলা মাঠের আল ধরে হাঁটছিলেন। শীতের কুয়াশা তখনো পুরোপুরি কাটেনি। দূরে দূরে ধানক্ষেতের সবুজের মাঝে লালচে সূর্যটা ঠিক যেন পতাকার রং মিশে গেছে প্রকৃতির সঙ্গে। হারান থমকে দাঁড়ালেন। বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করে উঠল। এটা বিজয়ের মাস। এই মাসেই তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর বড়ো ছেলে ইউসুফকে।
ইইসুফকে তিনি শেষ দেখেছিলেন মে মাসের একরাতে অস্ত্র হাতে মুক্তিসেনার বেশে। তরুণ ছেলেটার চোখে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল স্বাধীনতার আগুন। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে হারান মিয়া বলেছিলেন, “বাবা, সাবধানে যাস।” ইউসুফ সেদিন হেসে হেসে বলেছিল, “দেশের জন্য বেরিয়েছি, বাবা। ভয় কিসের?” কিন্তু ফেরেনি সে। সেদিন গুলিতে ঝরে গিয়েছিল তরুণদের রক্ত। হারান মিয়া ছেলের লাশ কাছে পাননি। কেবল পেয়েছিলেন তার রক্তে রাঙা মাফলারটি।
সেদিনের পর কেটে গেছে প্রায় তেপ্পান্ন/ চুয়ান্ন বছর। জীবনের নানা ঝড়ঝাপটা পাড়ি দিয়ে আজও তিনি বেঁচে আছেন। গ্রামের মানুষ জানে, হারান মিয়া নিঃশব্দ এক যোদ্ধা। যে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড়ো ব্যথাটা বুকে নিয়ে হাঁটেন, কিন্তু কারো সামনে আবেগ দেখান না। কেবল প্রতি বছর এই ডিসেম্বর মাসে তিনি ভোরে এসে দাঁড়ান মাঠের সীমানায়; যেখানে আকাশের লাল আর জমিনের সবুজ এক হয়ে যায়। তারপর ফিরে আসে ষোলোই ডিসেম্বর। ফিরে আসে বিজয় দিবস।
এখন গ্রামে গঞ্জে নতুন প্রজন্ম। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা পতাকা হাতে নিয়ে যাচ্ছিল সমাবেশে। তাদের একজন শাহিন, হারান মিয়াকে দেখে থেমে গেল। বলল “চাচা, আপনি যাবেন না? আজ তো শহিদদের জন্য অনুষ্ঠান।” হারান মিয়া একটু হাসলেন।
“যাব না কেন, বাবা? শুধু একটু দাঁড়িয়ে আমার ছেলের কথা মনে করছিলাম।” শাহিন লাজুক স্বরে জিজ্ঞেস করল, “চাচা, ইউসুফ ভাইয়ের গল্পটা কি শোনাবেন? আমাদের শিক্ষক বলছিলেন, তিনি নাকি অনেক সাহসী ছিলেন।”
এই শাহিনও একই গ্রামের আরেক মুক্তিসেনার ছেলে। হারান মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “সাহসী তো ছিলই। কিন্তু তার থেকে বেশি ছিল দেশের প্রতি প্রেম। সে বলত, দেশের মাটির গায়ের সবুজ, আর মানুষের রক্ত লাল। এই দুটো রং মিলে যা হয়, তাইতো আমাদের পতাকা।” শাহিন তাঁর কথা মন দিয়ে শুনছিল। হঠাৎ সে নিজের পতাকাটা তুলে ধরে বলল, “চাচা, আমরা ওদের মতো হতে চাই। দেশকে ভালোবাসতে চাই।” হারান মিয়ার চোখ দুটো ভিজে উঠল। তিনি বললেন,
“দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু যুদ্ধ না, বাবা। সৎ থাকা, পরিশ্রম করা, অন্যকে সাহায্য করা, এগুলোও দেশরক্ষার চাবিকাঠি। ইউসুফ যদি আজ বেঁচে থাকত, তাহলে তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের নিয়েই স্বপ্ন দেখত।” বাচ্চারা এগিয়ে এসে হারান মিয়ার হাত ধরল। যেন তারা অজান্তেই ইউসুফদের অসমাপ্ত স্বপ্নের অংশ হয়ে গেল। সমাবেশের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হারান মিয়া দেখলেন; সবুজ ধানক্ষেতের ওপর লাল সূর্যটা ঠিক যেন হাসছে। ঠিক যেন তাঁর ইউসুফদের মতোই। তিনি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন! আর চোখ মুছলেন!
সবুজের বুকে লাল” এ শুধু পতাকার রং নয়, এ দেশের মানুষের হৃদয়ের রং। আজ তিনি একা নন। তাঁর পাশে আছে নতুন প্রজন্ম; যারা এই রংকে বুকে ধারণ করে সামনে এগিয়ে যাবে। দেশ বাঁচবে তাদের স্বপ্নে, তাদের ভালোবাসায়।
হারান মিয়া ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বললেন,
“যতদিন এই সবুজের বুকে লাল থাকবে, ততদিন আমার ইউসুফ এবং ইউসুফের মতো লাখো লাখো বীরদের আত্মত্যাগ কখনই বৃথা যাবে না।”



















































