শাহারুল ইসলাম সুজন :
সজীব এবার সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে। তার বয়স ১৩ বছর। মা-বাবা ছাড়াও পরিবারে রয়েছে তিন বছরের এক ছোটভাই ও দাদা-দাদি। সবার কাছে সে অনেক আদরের ছেলে।
পড়ালেখার পাশাপাশি প্রতিটা কাজে রয়েছে তার আলাদা দক্ষতা ও যোগ্যতা। যতটুকু পারে সময় মতো ততটুকুই কাজ করে থাকে সজীব। সজীবের স্বপ্ন নিজেকে একজন সৎ, যোগ্য ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। মানুষকে ভালোবাসা এবং মানুষের পাশে থাকার মহান ব্রত ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে রয়েছে।
সবার সাথে ভালো ব্যবহার ও মিলেমিশে চলে সে। এজন্য গ্রামে সকলের কাছে সে অনেক প্রিয়। সজীবের বাবা তাদের গ্রামের মসজিদে ইমামতি করে। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে অভ্যস্ত সে। চলার পথের অপরিহার্য কাজগুলো ছাড়াও সে তার আব্বুর কাছে থেকে দেখে-শুনে অনেক কিছুই শিখেছে।
মাহে রমজান আসতে কয়েকদিন বাকি মাত্র। সজীব মসজিদ থেকে একটা রমজানের ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়ি আসলো। সজীব তার আম্মুকে সেটা দেখালো এবং বলল সে এবারের রমজানে সব কয়টা রোজা রাখবে। তখন তার আম্মু তাকে বলল, ‘তুমি কি সবগুলা রোজা থাকতে পারবে?’ সে একটু সাহসের সঙ্গে আম্মুকে বলল,‘আমি আমি বড় হয়ে গেছি। তোমাদের মতো আমিও রাখতে পারবো।’
তার আম্মু প্রথম একটু দ্বিমত পোষণ করলেও তার দাদা-দাদির কথায় এবং সজীবের জিদের সাথে পেরে উঠলো না। আম্মু বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি সবগুলোই থাকবে।’ এ কথা শুনে সজীবের খুশির সীমা রইল না। দৌড়ে সে খেলার মাঠে চলে গেল। সেখানে তার খেলার সাথী ও সহপাঠীদের সাথে এবার রমজানে সে সবগুলো রোজা রাখার সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দিল।
অন্যদের কাছে ও শুনল তারা কয়টা রোজা রাখবে। সবাই রাখবে কিন্তু সজীবের মতো সবকটা রাখার মতো একজনও নেই। সে সবাইকে বলল, তিনদিন পর থেকে রোজা শুরু। সবাই একসাথে মসজিদে তারাবিহর নামাজ ও ইফতার করব।
সবাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। সকাল গড়য়ে দুপুর নামল। সজীব বাসায় ফিরে এলো। এসে দেখে তার আব্বু কিছু লোকজনের সাথে রমজানের আলোচনা করছে। সজীবও সেখানে বসে গেল। মনোযোগ সহকারে সে কথাগুলো শুনতে লাগলো।
হঠাৎ সজীব বলে উঠলো, ‘আব্বু, এবার রোজা কি ত্রিশটা হবে, নাকি ঊনত্রিশটা?’ আব্বু বলল, ‘চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করবে যে এবার রমজানে কয়টা রোজা হবে।’ সজীব বিষয়টা বুঝতে পারল। সবার সামনে আবারো সবকটা রোজা রাখার অঙ্গীকারের কথা জানালো। সবাই তো হতবাক!
সবাই সজীবের প্রশংসা করতে লাগল। সজীব খুশি হলো। এভাবে দিন পেরিয়ে রমজানের দিন এলো। রাতে পশ্চিমাকাশে চাঁদ দেখে সে কি আনন্দ! আনন্দে নাচতে শুরু করে দিল। তখন তার আব্বু তাকে বলল, ‘আজ রমজানের প্রথম রাত সবাইকে মসজিদে তারাবিহর সালাত আদায় করতে হবে।
সবাই আজানের সাথে সাথে মসজিদ উপস্থিত হবে।’ সজীব তক্ষুণি গ্রামের সকলকে খবরটা দিয়ে দিল। তারপর সজীব তার আব্বুর সাথে ওজু করে মসজিদের দিকে রওনা দিল। এশার নামাজের আজান শেষ। যতক্ষণ না নামাজ শুরু হয় ও ততক্ষণ একখানা হাদিস পড়তে লাগলো।
তারপর সবাই মিলে একসাথে তার আব্বুর পিছনে এক এক করে ফরজ, সুন্নত, তারাবিহ ও ওয়াজিব নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ হওয়ার পর সবাই মিলে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করে বাসায় ফিরে আসে। সজীবের মনটা ভীষণ খুশি।
একবছর পরে আজ থেকে আবার রোজা শুরু হবে, পৃথিবীতে আল্লাহতালার রহমত বর্ষিত হবে। তার ইচ্ছা সে রমজান মাসটা সর্বক্ষণ ইবাদত করে কাটাবে। বসে বসে এসব ভাবতে লাগল সে। তার আম্মু রাতের খাবার পরিবেশন করল। আজকের খাবারের মাঝে ভিন্নতা লক্ষ করলো সজীব।
অনেক ধরনের খাবার রান্না করেছে আম্মু। হঠাৎ করে তার মনে পড়ল, তাদের বাড়ির পাশে স্বামী-ছেলেহারা এক অসহায় বৃদ্ধা থাকে। সে আম্মুকে বলল,একটা থালায় করে কিছু খাবার দিতে। সে ওই বৃদ্ধার বাসায় দিয়ে আসবে। আব্বু বলল, ঠিক আছে আগে খেয়ে নাও।
তোমার আম্মু গুছিয়ে রেখে দেবে। খাবারের পর তুমি দিয়ে এসো। যে কথা সেই কাজ। খাওয়া শেষ হওয়ার পরপরই হাতে টর্চলাইট নিয়ে সে খাবার নিয়ে বৃদ্ধার বাসায় দিয়ে আসল। এরপর বাসায় ফিরে সে তার রুমে ঘুমাতে গেল।
ঘুমানোর আগে মোবাইলে এলার্ম সেট করে রাখল, যেন সঠিক সময়ে ঘুম থেকে জাগতে পারে। সেহরি খাওয়ার সময় হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই ওঠে পড়ল। আব্বু-আম্মু, দাদা-দাদি এক এক করে সবাইকে জাগিয়ে দিল। তারপর সবাই মিলে একসাথে সেহরি খেয়ে নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
সজীব তার আব্বুর সাথে মসজিদে চলে যায় নামাজ পড়তে। নামাজ পড়ে সে কিছুক্ষণ ধরে কোরআন শরীফ পড়তে থাকে, এরপর বাসায় এসে ছোটভাইকে নিয়ে খেলাধুলায় মেতে থাকে। ফাঁকে ফাঁকে খাতা-কলমে টুকিটাকি লেখালেখিও করে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। তখন সে তার আম্মুর রান্নার কাজে সাহায্য করল।
আসরের আজান হলে সে মসজিদে চলে গেল নামাজ পড়তে। নামাজ পড়ার পর সে অন্য ছেলেদের সাথে ইফতারি পরিবেশন করতে শুরু করে দিল। এক এক করে ইফতারের প্লেটগুলো পরিষ্কার করা, টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে আসা, এসব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। ইফতারের সময় হতে অল্প একটু বাকি থাকতে সে নিজেও ইফতার নিয়ে বসে পড়ে।
সবার মতো সেও কলমা-দরুদ ও ইস্তেগফার পড়তে থাকে। ইফতারের সময় হলে ইফতারের দোয়া পড়ে পানাহার করে রবের শুকরিয়া জ্ঞাপন করল। অতঃপর মাগরিবের নামাজ পড়ে আব্বুর সাথে বাসায় ফিরে এলো। এসেই আম্মুকে বলল কিছু খেতে দিতে। এক্ষুণি আবার তারাবিহ পড়তে যেতে হবে।
সজীবের একটা অভ্যাস, সে প্রতি সন্ধ্যায় তার আব্বুর কাছ থেকে ইসলামিক গল্প শুনে। কিন্তু আজ তার উল্টোটা ঘটলো। সে তার আব্বুকে বলল আজ সে তাদের একটা ইসলামিক গল্প শোনাবে। আব্বু এটা শুনে ও ছোট ছেলের কর্মকা- দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। তখন খুশিতে কাঁদো কাঁদো হয়ে সজীবকে বুকে টেনে নিলেন এবং বললেন, হ্যাঁ বাবা, আজ থেকে তুমিই গল্প শোনাবে এবং আমাদের সাথে সব কটা রোজা রাখবে। একথা শুনে সজীব খুশিতে মাথা কাত করে সায় দিল।