সংবিধান সংস্কারে যেসব প্রস্তাবনা থাকছে

সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিবে আজ

সুপ্রভাত ডেস্ক »

সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে যাচ্ছে আজ। এতে ক্ষমতা কাঠামো, সংসদের ধরনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাবনা থাকছে।

৫ অগাস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে দেশটিতে। সেই প্রেক্ষাপটে প্রাথমিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সংস্কারে ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

পরবর্তীতে ৭ অক্টোবর ‘বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে’ অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে নয় সদস্যের সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।

তিন মাস ধরে সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনদের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করে কমিশন। প্রায় এক লাখ লোকের মতামত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন। সেই সাথে তারা বিভিন্ন দেশের সংবিধানও পর্যালোচনা করেন।

এসবের ভিত্তিতে পাঁচ খণ্ডের প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

প্রথম খণ্ডে রাখা হয়েছে সুপারিশ এবং সুপারিশগুলোর যৌক্তিকতা। বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রাপ্ত মতামত রাখা হয়েছে বাকি চার খণ্ডে।

বাংলাদেশের সংবিধান এ পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বদলে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনরায় প্রবর্তন করা হয়।

সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে যে ‘একচ্ছত্র আধিপত্য ও ক্ষমতা’ দিয়েছে, সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কথা বিভিন্ন পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই বলা হচ্ছিল।

অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলে আসছে।

ক্ষমতার ভারসাম্য

সংস্কার কমিশন ভারসাম্য আনতে চাইছে ‘প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর’ মধ্য দিয়ে। দেশ পরিচালনায় রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের (আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা বলা হচ্ছে।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের কাঠামো দাঁড় করানোর কথা প্রস্তাবনায় থাকছে বলে জানা গেছে, তাতে অন্য দুই বিভাগের সাথে আইনসভার সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

এতে নির্বাহী প্রধান তথা সরকার প্রধানের এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে সেটা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।

দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ

বর্তমানে বাংলাদেশের এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসনসহ মোট ৩৫০টি আসন রয়েছে।

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাবনা আসতে যাচ্ছে তা একরকম অনুমান করা যাচ্ছিল। কেননা, বর্তমানে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সবাই দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে।

সংসদের নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা বেড়ে চারশো হওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর সঙ্গে উচ্চকক্ষে আরো ১০৫ টি আসন যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

নিম্নকক্ষের চারশো আসনের ১০০ টি নারী আসন। তবে, কেবল দলের মনোনয়নে নয়, তাদেরও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে হবে।

উচ্চকক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতিতে সদস্য নির্ধারণ করা হবে। সাধারণ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী উচ্চকক্ষে আসন পাবে দলটি।

সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যেন থাকে, সে ব্যাপারেও একটা ধারণা দেয়া হবে।

৭০ অনুচ্ছেদ

বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম আলোচিত অংশ ৭০ অনুচ্ছেদ। এতে বলা হয়েছে – “কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তিনি যদি নিজ দল থেকে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহলে সংসদে তার আসনটি আসন শূন্য বলে বিবেচিত হবে।”

নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার সুযোগ না থাকায় সংসদ সদস্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয় বলে মনে করেন অনেকে। অনুচ্ছেদটি থাকা না থাকার প্রশ্ন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে সুস্পষ্ট সুপারিশ থাকছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছিল ২০০৭ সালে।

লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব মুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

কিন্তু, বিগত দিনে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, বিচার বিভাগ আদতে স্বাধীন নয়, সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ীই পরিচালিত হয়।

‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে’ সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সেক্রেটারিয়েট বা সচিবালয় তৈরির সুপারিশ করতে যাচ্ছে।

সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে প্রস্তাবনা রাখা হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার

বাংলাদেশে প্রায় এক দশক ধরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে হয়ে আসছিল। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নের সংসদ সদস্যদের তহবিল বরাদ্দসহ তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো হয়েছিল। এসব কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকার নির্ভর হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় সরকারগুলো শক্তিশালী করা ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার প্রস্তাবনা থাকছে।