গজল মানে প্রেমাস্পদের সাথে কথোপকথন। গজলের জন্ম আরবে। সমৃদ্ধি লাভ করে পারস্যে এসে। পারস্য সভ্যতা আরবীয়দের চেয়ে অনেক পুরানো। পারস্যে গজল এক আলাদা কবিতার ধরন হিসেবে কাঠামো পায়। গজলের যে চিরচেনা রূপ – রাদিফ, কাফিয়া, মাখতা, মাতলা, তাখাল্লুস এগুলো পারস্য গজলে জন্ম নেয়া। গজল সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় হয় ভারতবর্ষে এসে।
গজল শ্রুতি-পাঠ নির্ভর। স্মৃতিতে ধারণ করা সহজ। গান হিসেবে গাওয়ার জন্য লেখা কবিতা। গজল মোটামেুটিভাবে ১০ চরণ থেকে ২০ চরণের কবিতা। প্রতিটি চরণকে বলা হয় ‘মিস্রা’। দুটি মিস্রা নিয়ে গঠিত হয় একটি ‘শের’। গজলে সাধারণত পাঁচ থেকে দশটি শের থাকে। কখনো কখনো বেশিও থাকে।
শের উর্দু কবিতার একটি ছোট অংশ, যা দুটি চরণে বা লাইনে গঠিত হয়। এই দুটি লাইন একটি নির্দিষ্ট ছন্দের সাথে মিলে একটি সম্পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে।
ভারতীয় আদিভাষার অপভ্রংশ থেকে জন্ম নেয়া ভাষা– উর্দু। যাকে প্রথম চিহ্নিত করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর ফারসি কবি ও সঙ্গীতকার আমীর খসরু। যাঁর বাবা তুর্কি আর মা ভারতীয়। খসরু প্রচলিত কাওয়ালীর জনক ও হিন্দুস্তানি খেয়ালের অন্যতম রূপকার। তিনি খোল থেকে তবলা বানান এবং সেতার সংস্কার করে বর্তমান রূপ দেন।
উর্দু খুব শ্রুতি মধুর ভাষা। রাস্তায় জন্ম নিলেও পরবর্তীকালে রাজদরবারে লালিত হয়েছে। উর্দুর শব্দাবলিই শুধু নয়, বাগভঙ্গিও পরিচ্ছন্ন এবং মার্জিত। এই ভাষার ধ্বনিমাধুর্য অন্য ভাষাভাষী মানুষদেরও আকর্ষণ করে।
একেকটি ভাষা মানে একেক জাতি। কিন্তু উর্দু এমন একটি ভাষা যার সাথে নির্দিষ্ট কোন জাতির সম্পর্ক নেই। ঔপনিবেশিক ইতিহাসের চক্করে পড়ে উর্দু হয়ে গেছে মুসলমানদের ভাষা। উর্দু ভাষার ৭৫ শতাংশ শব্দ প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে।
উর্দু ভাষা গড়ে উঠেছিল সাধারণ হাটবাজারের মানুষের বুলি থেকে। দিল্লি জামে মসজিদ থেকে লালকিল্লা পর্যন্ত ছিল ঘনবসতি। এই বসতির মানুষের বোলচালই উর্দু ভাষার সনদ। আর আমজনতার মুখের ভাষা হতেই গড়ে উঠেছে আজকের উর্দু কবিতা – নাজম, গজল, শের-শায়েরি।
উর্দু কবিতার বিকাশ ঘটেছে দুইভাবে। মীর তকি মীর আর সমকালীন কবিরা সাধারণ লোকের বোলচাল কবিতায় বদলে এনেছিলেন। আর অপরদিকে ফারসি সাহিত্য পরম্পরা থেকে সম্পদ আহরণ করে উর্দু কবিতা সমৃদ্ধি লাভ করে।
উর্দু সাহিত্যে ধ্রুপদি ধারা গজল। এই গজল থেকে নেয়া শের সুপ্রভাত পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো। আগামীতে আরও কয়েকটি পর্বে নির্বাচিত শের-শায়েরি শিল্প সাহিত্য পাতায় ছাপানো হবে।
প্রথম পর্ব
১.
পত্তা পত্তা বুটা বুটা হাল হামারা জানে হ্যায়
জানে ন জানে গুল হি ন জানে বাগ তো সারা জানে হ্যায়
[ পত্তা – পাতা; বুটা – বোঁটা; গুল – ফুল; বাগ – বাগান ]
আমার যে কি হাল প্রতিটি পাতা প্রতিটি অঙ্কুর (বোটাঁ) জানে
সেই ফুল জানে কি না জানি না, সারা পুস্পকুঞ্জ (বাগান) তা জানে
২.
ইবতিদায়ে ইশক হ্যায় রোতা হ্যায় কেয়া
আগে আগে দেখিয়ে হোতা হ্যায় কেয়া
[ ইবতিদা – আরম্ভ; ইশক – গভীর ভালোবাসা; আগে আগে – ক্রমশ ]
ভালোবাসার এই তো শুরু, এখনই কাঁদছ!
দেখ, সামনে আরও কত কী হয়
৩.
গুল-ও-বুলবুল বাহার মে দেখা
ইক তুঝকো হাযার মে দেখা
[ গুল – ফুল; বাহার – বসন্ত; ইক – এক; তুঝকো – তোমাকে ]
ফুল আর বুলবুল বসন্তে দেখলাম
এক তোমাকেই হাজার রূপে দেখলাম
৪.
অয় হুববে জাহ্ ওয়ালোঁ, জো আজ তাজওয়ার হ্যায়
কাল উসকো দেখিয়ে তুম, ন তাজ হ্যায় ন সর হ্যায়
[ অয় – হে; হুব – ভালোবাসা, আসক্তি; জাহ্ – ক্ষমতা;
তাজওয়ার – মুকুটধারী; উসকো – ওকে; সর- মাথা ]
ওহে ক্ষমতালোলুপ, তুমি মুকুট দেখছো যে মাথায়
কাল তাকিয়ে দেখবে মুকুটও নেই, মাথাও গায়েব
শায়ের (কবি): মীর মুহাম্মদ তকি
তাখাল্লুস বা কবি নাম: মীর তকি মীর
মীর তকি মীর
জন্ম : ফেব্রুয়ারি, ১৭২৩ আগ্রা
মৃত্যু : ২০ সেপ্টেম্বর, ১৮১০ লখ্নউ
উর্দু ভাষাকে আজকের কবিতার ভাষা হিসেবে গড়ে তোলার ইতিহাসে মীর তকি মীরের ভূমিকা ব্যাপক। উর্দু কাব্যের জগতে একজনকেই কাব্যের খোদা বলা হয়। যিনি ‘খুদায়ে সুখান’, মানে কাব্যেশ্বর। এই উপাধির সর্বস্বীকৃত দাবিদার মীর তকি মীর।
মীরের বাবা ছিলেন আগ্রার বিখ্যাত একজন সুফি। নাম মুহাম্মদ আলী। লোকে সম্মান করে ডাকতো আলী মুত্তাকি। মুত্তাকি মানে জাগতিক বিষয়ে উদাসীন। তিনি ছিলেন একজন মান্য দরবেশ। মীর নিজেও সুফি দর্শন অনুসারী।
মীর তকি মীর আধুনিক উর্দু কবিতার জনক মির্জা গালিবের আগের শতাব্দীর মানুষ। গালিব নিজেও মীরের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতেন। এবিষয়ে গালিবের একটি শের আছে –
রেখতহ্ কে তুমহি উস্তাদ নেহি হো গালিব
কহতে হ্যাঁয় আগলে জমানে মেঁ কোয়ি মীর ভি থা
তুমি একাই উর্দু কাব্যের পুরোধা নও গালিব
লোকে বলে তোমার আগে মীর বলেও একজন ছিলেন
উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসকার রালফ্ রাসেলের মতে, মীর বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবি। মীর সহজতর কবি হিসেবে খ্যাত। তাঁর কবিতায় আছে বেদনা আর উত্তাপ।
চয়ন ও উপস্থাপনা: রুশো মাহমুদ
কৃতজ্ঞতা: আবু সায়ীদ আইয়ুব, জাহিরুল হাসান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শচীন ভৌমিক, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, আয়ান রশীদ, জাভেদ হুসেন, আসাদ চৌধুরী, সৈয়দ মবনু, সফিকুন্নবী সামাদীসহ যারা বাংলা ভাষায় শের-শায়েরি চর্চা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন।