সুপ্রভাত ডেস্ক »
শেখ হাসিনাকে ডুবিয়েছেন আওয়ামী লীগের চার নেতা। বুধবার (২২ আগস্ট) বর্তমানে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের বরাতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ সংক্রান্ত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে এ চার নেতা শেখ হাসিনাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছিলেন। ফলে অন্যান্য নেতাদের মনোভাব তার কাছে পৌঁছাত না। অথচ তারা বুঝতে পারছিলেন জনগণ ক্ষেপে আছে কিন্তু শেখ হাসিনা তা বুঝতে চাইতেন না। টানা চারবার ক্ষমতায় আসার পর উনার এ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় বলে দাবি করেছেন দলটির নেতারা। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় নেতারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হচ্ছেন। তারপরও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে পোষণ করছেন। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকেই উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছেন তারা। বিষেষ করে এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়েও মত দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে তারা বলে যে ‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব না’; ‘আমি আত্মগোপনে আছি, ফোনে কথা বলতে পারি’; ‘নিরাপদ কোনো স্থানে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করব’; ‘আপনার গতিবিধি নজরদারি করা হবে, তাই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব কিনা, জানি না’।
এগুলো ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ তার দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ও সাবেক সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সদস্যদের পাঠানো কিছু বার্তা; যা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পেয়েছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গত এক সপ্তাহে এ ব্যক্তিদের কারো কারো সঙ্গে অজ্ঞাত স্থানে দেখা করতে এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতিশোধের শিকার হওয়ার শঙ্কায় আত্মগোপনে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয়।
তাদের অভিন্ন কথা, শেখ হাসিনা দল ও জনগণকে পরিত্যাগ করেছেন। আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আপা (হাসিনা) আমাদের ছেড়ে গেছেন।
নেতা–কর্মীদের পরিত্যাগ করে শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার একই অনুভূতি শেয়ার করছেন আরো অনেকেই। ৫ আগস্টের পরিণতি তারা আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি। সেদিন শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ ভারতে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত তার মন্ত্রিসভার সদস্য, এমনকি ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও পুরোপুরি বিস্মিত করেছে। এক নেতা বলেন, আমরা টেলিভিশনের খবর থেকে এটা জানতে পারি।
এভাবে শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার ঘটনা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের জীবন বিপদের মধ্যে ফেলেছে। বিক্ষোভকারী, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এবং সুযোগসন্ধানীরা আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দলীয় কার্যালয়গুলো নিশানা বানান। করা হয় অগ্নিসংযোগ, লুট; চালানো হয় ভাংচুর।
আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর আমরা একটা সময়ই শুধু বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাই। সেটি সেনাপ্রধান যখন বেলা তিনটার দিকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ও মানুষ তা শুনতে টেলিভিশনের পর্দায় নজর রাখছিলেন।
আরেক নেতা ও সাবেক সরকারের মন্ত্রী বলেন, আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা ধরা পড়লে লোকজন আমাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারতেন।
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী দলের নেতাদের কারাগারে পাঠায়, মারধর করে, ভয়ভীতি দেখায় ও হয়রানি করে। কিন্তু পরে হঠাৎই পরিস্থিতি উল্টে যায়।
সাম্প্রতিকতম ঘটনার খানিকটা পেছনে তাকালে দেখা যাবে, ঘটনাপ্রবাহে কেউ কেউ বিশেষ করে গত জুলাইয়ে শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পরে ৩–৪ আগস্ট ছাত্র–জনতা রাস্তায় নেমে আসেন। ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা কারফিউ ভাঙেন। সেদিনই সরকারের পতন ঘটে।
অভিযুক্ত ‘গ্যাং অব ফোর’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য আত্মগোপনে থাকা ওই নেতাদের একজন দলের অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠীকে দায়ী করে বলেছেন, তিনি (শেখ হাসিনা) আমাদের কথা শোনেননি। এ গোষ্ঠীকে ‘গ্যাং অব ফোর’ বলে আখ্যায়িত করেন নেতাদের একজন। তিনি বলেন, গোষ্ঠীটি শেখ হাসিনাকে বাস্তব অবস্থা বুঝতে দেয়নি।
এ চার নেতা হলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ (জয়), বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, চারজনের এ দল তার (হাসিনা) পতনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ ব্যক্তিদের ওপর তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। তার যে সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তা তিনি তাদের কারণে হারিয়েছেন।
বিএনপিকে নির্বাচনে না আনা ‘ভুল’ ছিল
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপিকে না আনা শেখ হাসিনার একটি ‘বড় ভুল’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সূত্রগুলো বলেছে, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে লন্ডনে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
একটি সূত্রের ভাষ্যমতে, আড়ালে থাকা একটি চ্যানেলের মাধ্যমে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার প্রস্তাবও দেয়া হয়। আমাদের ধারণা, তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় চ্যানেলটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের এক বছর আগেই ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়, কিন্তু শেখ হাসিনা ওই প্রস্তাবে সবুজসংকেত দেননি।
আওয়ামী লীগের একজন নেতার বক্তব্য, বিএনপি চেয়ারপারসনের ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টি শেখ হাসিনার প্রত্যাখ্যান করা ছিল সাংঘাতিক ভুল। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিএনপিকে নির্বাচনে আনা গেলে বিরোধীদের রাগ–ক্ষোভ হয়তো মিটে যেত।
ওই নেতা বলেন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, পুলিশের নিষ্ঠুরতায় জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা বুঝছিলাম। বিএনপিকে নির্বাচনী তরিতে ওঠানো গেলে সেই ক্ষোভ হয়তো থামানোও যেত। তাতে আমরাই আবার জিততে পারতাম এবং দল ক্ষমতায় থাকত।
নেতা–কর্মীরা মনে করেন, বিশেষ করে গত জানুয়ারির নির্বাচনে জেতার পর শেখ হাসিনা আরো একগুঁয়ে হয়ে ওঠেন ও কোনো পরামর্শ শোনেননি। এ প্রসঙ্গে ওই নেতা বলেন, টানা চতুর্থবার জিতে তিনি (হাসিনা) অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং কোটা সংস্কার নিয়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে সৃষ্ট ক্ষোভের মাত্রা বুঝতে ব্যর্থ হন।
সূত্রগুলো বলেছে, কৌশলে কিছু নেতা শেখ হাসিনাকে জুলাইয়ের শুরুতে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। হাসিনা সরকারের কফিনে শেষ পেরেকটি তখনই বসে, যখন একই মাসে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা ছাত্রনেতাদের তুলে নিয়ে যান এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে ও আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারে জোরপূর্বক প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।
এ কৌশল হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। কর্মসূচি প্রত্যাহারে কীভাবে জোরপূর্বক প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়েছে, ছাত্রনেতারা সে বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। এটি বেশ কিছু ঘটনার সূত্রপাত ঘটায় এবং শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
শেখ হাসিনার পতনের পর জীবননাশের শঙ্কায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা–কর্মী বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেন।
আশ্রয় নেয়া এ ৬২৬ জনের মধ্যে ছিলেন নানা শ্রেণীপেশার মানুষ। তাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা, ৫ জন বিচারক, বেসামরিক প্রশাসনের ১৯ কর্মকর্তা, ২৮ পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন পদের ৪৮৭ জন পুলিশ সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ নানা পেশার ১২ জন ও ৫১টি পরিবার।
ঘটনাপ্রবাহে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টাকালে আটক হন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আত্মগোপন করেছেন, কেউবা গ্রেফতার হয়েছেন। নেতারা বলছেন, ৫০ বছরের পুরনো যে দল টানা ১৫ বছরের বেশি দেশ শাসন করেছে, তারাই এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন।
এদিকে দল গোছানোর ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের প্রথম পদক্ষেপ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের একজন বলেন, ‘দলকে পুনর্গঠনে তাকে (শেখ হাসিনা) তৃণমূল পর্যায়ের লোকজন বাছাই করতে হবে, তাদের মধ্যে থাকবেন কিছু তরুণ আওয়ামী নেতা; মাঠপর্যায়ে যাদের ব্যাপারে মানুষের আস্থা আছে, লোকজনের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে এবং অবশ্যই শেখ হাসিনার পরিবারের প্রতি অনুগত, এ যাত্রা দীর্ঘ হবে।’
এ নেতা বলেন, আমাদের শক্ত ঘাঁটি ও কর্মী বাহিনী রয়েছে। অনেকে বিপথগামী হয়েছেন, যেমনটা ঘটেছে সুবিধাবাদীদের ক্ষেত্রে। সমর্থকদের মধ্যেও এমনটা থাকবে। কিন্তু আমাদের অন্তত এমন কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থাকা দরকার; যারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ও নির্বাচন যখনই হোক, তাতে অংশ নেবে। এখন এটিই প্রয়োজন।
এ পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরার বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রুহুল কবির রিজভীর মতো কয়েকজন নেতার ভূমিকার দিকে তিনি ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাকালে ও তারেক রহমান বিদেশে অবস্থানকালে বিএনপির দুর্গ সামলেছেন তারা।
দেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাব বিরাজ করায় শেখ হাসিনার পরিবার ও এর উত্তরসূরি সজীব ওয়াজেদ জয়ের খুব কম বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া উচিত বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
আওয়ামী লীগের নেতাদের একজন বলেন, লোকজন এখনো ক্ষেপে আছেন। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের সময় দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার বা বিএনপি কিংবা জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সরকার যে–ই কয়েকটা বছর ক্ষমতায় থাকুক, আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের আবার সংগঠিত হওয়ার কথা ভাবতে হবে।