শিশুতোষ নাটক : কিশোর মুজিব

শারমিন সুলতানা রাশা »

 

গত সপ্তাহের পর

দৃশ্য: ৫

সময়: সকাল

স্থান: গফুর মিয়ার বাড়ি!

চরিত্র: মুজিব, পিন্টু , গফুর মিয়া, মুজিবের সঙ্গীরা

[মুজিব ও তার কয়েকজন সঙ্গী মিলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরিব ছাত্রদের জন্য সাহায্য তোলে]

পিন্টু: বাড়িতে কেউ আছেন? আমাদের একটু সাহায্য করুন! [গফুর মিয়া বেরিয়ে এল]

গফুর:    কে? ও.. তোমরা? আবার এসেছ?

মুজিব:   চাচা, আমাদের অনেক দরিদ্র মেধাবী ছাত্র টাকার অভাবে বই কিনতে পারছে না, পরীক্ষার ফিস জমা দিতে পারছে না। ওদের জন্যই আমরা সাহায্য তুলছি! দেন না যা পারেন! এই তোরা গফুর চাচার কাছ থেকে নে। আমরা ওদিকের বাড়িগুলোতে যাই। [মুজিব ও কয়েকজন অন্যদিকে যায়]

গফুর:    তোমরা না কদিন আগেও আসলে?

পিন্টু:     সে তো গত রবিবার! আর আপনি তো এর আগের রবিবার বললেন, পরে কখনও আসতে। তাই এখন এলাম!

গফুর:    পরের রবিবার তো আবার আসবা, তাই না? তখন নিও!

মন্টু:      কখন চাচা?

গফুর:    পরের রবিবার।

পিন্টু:     আবার পরের রবিবার? কবে রবিবার হবে? চাচা আপনি বরং আজই দিন!

গফুর:    আজ দেব মানে? মগের মুল্লুক? বেশি পীড়াপীড়ি করলে পরের রবিবারও দেব না! এখন তোমরা যাও! যাও বলছি!

মন্টু:      দেবেন না? দেবেন না তো? বেশ! এই চল! [সকলের প্রস্থান। কাকন ও আসাদ এর প্রবেশ]

আসাদ:  এ কোথায় এলাম! হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম,  কিন্তু এখনও বঙ্গবন্ধুর দেখা মিললো না। আমরা ভুল জায়গায় এসে পড়লাম না তো?

কাকন:  বুঝতে পারছি না ঠিক। চলো ওদিকটায় গিয়ে খুঁজি।

আসাদ: তুমি যাও। আমি ভীষণ ক্লান্ত!

কাকন : বেশ। সাবধানে থেকো,  দেখো আবার যেন গ্রামের ছেলেমেয়েরা লম্বা চুল দেখে পাগল না ভাবে! হা হা হা! [কাকনের প্রস্থান]

আসাদ: এখানে দেখছি অনেকগুলো বাড়ি। কোন বাড়িটা হতে পারে? [বাড়ির চালে ঢিল ছুঁড়লো কেউ] [বাড়ির ভিতর থেকে গফুর মিয়া বেরিয়ে এল]

গফুর [নেপথ্যে]: এই,  কোন পাঁজি হতচ্ছাড়া পাথর মারে রে? [গফুর মিয়া লাঠি হাতে বেরিয়ে এল]

গফুর মিয়া:        ও! তাহলে তুই? তুই আমার নতুন ঘরের চালে পাথর মেরেছিস?

আসাদ: আরে? আমি কেন আপনার ঘরে পাথর মারতে যাবো? আপনি ভুল করছেন। আর আমি তো এখানকার নই! এই সময়েরও নই! আমি এসেছি অনেক দূর থেকে!

গফুর মিয়া:        কি সব বলে ! পাগল নাকি?

আসাদ:              দেখুন একজন সাইন্টিস্টকে আপনি এভাবে পাগল বলতে পারেন না!

গফুর:    সাইন্টিস্ট? সাইন্টিস্টের এরকম লম্বা লম্বা চুল থাকে নাকি! উহুম! গায়ের জামাটা কি নোংরা!  আর কি একটা চশমা পরেছে, নিজের মাথার থেকে বড়! আবার বলে সাইন্টিস্ট! [পুনরায় ঢিল ছোঁড়ে কেউ]

আবার ছুঁড়েছিস ঢিল! তবে রে হতচ্ছাড়া!

[গফুর মিয়া আসাদকে তাড়া করলো। আসাদ পালানোর চেষ্টা করে]

[পাশ থেকে লুকিয়ে একদল কিশোর হাসে]

গফুর :   ও!  এবার বুঝেছি! তোরা মুজিবের বিচ্ছু বাহিনী? দেই নাই বলে আমার উপর শোধ নেয়া হচ্ছে! দেখাচ্ছি মজা! সবকটার বাড়িতে যদি নালিশ নিয়া না যাই, আমার নাম গফুর মিয়া না!

দৃশ্য: ৬

স্থান: গাছতলা

সময়: পড়ন্ত বিকাল

চরিত্র: মুজিব, পিন্টু, মন্টু, মোতালেব, মুজিবের অন্যান্য সঙ্গীরা

[মুজিব ও তার সঙ্গীরা দরিদ্র ছাত্রদের বই ও সাহায্য বিতরণ করছে। মুজিব নিজের হাতে মোতালেবকে পরীক্ষার ফিস তুলে দিল। মোতালেব হাসলো]

মোতালেব:         মুজিব! তুই না থাকলে আমাদের মত দরিদ্র ছাত্রদের যে কি হতো!

মুজিব:               আমি একা কিছুই করি নাই! আমার সাথে আমার এই বন্ধুরাও ছিল! [মুজিবের সঙ্গীরা একে অপরের দিকে তাকায়। মাগরিবের আযান পড়লো]

মুজিব:   ঐ আযান পড়লো। এবার বাড়ি যেতে হবে!

দৃশ্য: ৭

স্থান: মুজিবদের বাড়ি

সময়: সন্ধ্যা

চরিত্র: মুজিব, মুজিবের বাবা, গফুর মিয়া

[মুজিবের বাবা ও গফুর মিয়া মুজিবের জন্য অপেক্ষা করছে। মুজিব ধীর পায়ে বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করে]

মুজিবের বাবা: খোকা! [মুজিব চমকে তাকায়। দেখে বাবা ও গফুর মিয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে]

মুজিব: আব্বা!

বাবা: কি রে খোকা? তোরা গফুরদের বাড়ির চালে ইট মারছিস? [মুজিব নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে]

বাবা:     কথা বলছিস না কেন? সত্য করে বল্!

মুজিব:   হ্যাঁ মারছি!

গফুর:    শুনলেন তো? আপনে তো বলছিলেন আপনার খোকা কোন অন্যায় করতে পারে না! এবার দেখলেন তো? এইবার নিশ্চয়ই আপনি চুপ কইরা থাকবেন না!

বাবা:     দাঁড়ান! আমি আগে জানতে চাই, আমার খোকা কি কারণে এরকম কাজ করছে। [বাবা খোকার দিকে তাকায়]

বাবা:     খোকা! সত্যি করে বল্! কেন করছিস এই রকম?

মুজিব:   আব্বা! আপনি তো জানেন,  আমাদের একটা সেবা সমিতি আছে। প্রতি রবিবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য তুলি, যা থেকে দরিদ্র ছাত্রদের বই কেনা, পরীক্ষার ফিস জমা দেয়া আর অন্যান্য খরচ চালানো হয়!

বাবা:     হ্যাঁ জানি। তোর কোন কাজ তো আমার অজানা নাই। কিন্তু তার সাথে গফুর মিয়ার বাড়ির চালে ইট মারার সম্পর্ক কি?

গফুর:    ও আর কি বলবে? আমিই বলি! আমি বললাম তোমরা যে কাজ করো সেটা তো খুবই ভালো কাজ। কিন্তু আমার হাতে এখন টাকা নাই, পরের রবিবার আইসো। কে শোনে কার কথা! তারা আমার নতুন ঘরের চালে ইট মারলো! কত বড় সাহস! এর উচিত বিচার আপনি করেন!

মুজিব:   চাচা! ক্ষমা করবেন আমাদের। আপনি তো প্রতি রবিবার একই কথা বলেন। আপনার তো অনেক আছে। গরিব ছাত্রদের একটুখানি সহযোগিতা করলে আপনার কি খুব ক্ষতি হবে চাচা?

বাবা:     গফুর মিয়া, আমার ছেলে বইলা বলতেছি না ।  খোকা কিন্তু ভুল কিছু বলে নাই। মানুষ মানুষের জন্য না করলে আর কে করবে বলেন? কিন্তু খোকা, তাই বলে এভাবে ঘরের চালে ইট মারাটা কিন্তু তোমাদের উচিত হয় নাই।

মুজিব:   সেই জন্য আমি সবার হয়ে ক্ষমা চাইতেছি। চাচা, আর আমরা আপনার চালে ইট মারবো না। আমি সবার হইয়া কথা দিলাম।  এবার আপনি আমাদের ক্ষমা করছেন তো?

গফুর :   আর ক্ষমা চাইতে হইবো  না। তোমার ব্যবহারে আমি খুশি হইলাম! দোয়া করি, তুমি অনেক বড় হও। অনেক বড় হও। আর শোন, পরের রবিবার কিন্তু তোমরা সত্যিই আসবা আমার বাড়িতে! এবার আর তোমাদের ফেরাবো না। কথা দিলাম। [গফুর চলে যায়। মুজিবের বাবা তাকিয়ে থাকে]

বাবা:     খোকা! অনেক হইছে! এবার যাও পড়তে বসো!

দৃশ্য: ৮

স্থান: স্কুলের মাঠ

সময়: সকাল

চরিত্র: মুজিব, পিন্টু, মুজিবের সঙ্গীরা

পিন্টু:     শুনেছ খবরটা? আমাদের স্কুল পরিদর্শনে নাকি বাংলার প্রধানমন্ত্রী আসছেন!

মন্টু:      তাই নাকি? তাহলে তো আমাদের ছাত্রদেরও প্রস্তুতি নিতে হয়!

পিন্টু: কিসের প্রস্তুতি?

মন্টু : তাঁকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি!

মুজিব: হ্যাঁ! সেই সঙ্গে আমাদের ছাত্রদের প্রয়োজনের কথাটাও তাঁর কাছে তুলতে হবে! আমাদের দাবি!

পিন্টু-মন্টু: আমাদের দাবি?

[আসাদ ও কাকন এর প্রবেশ]

আসাদ: আরে! ওদের সাহস দেখেছ? কিশোরদল ওরা নাকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি পেশ করবে? আরে ওরা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যেতে পারবে?

কাকন: দেখোই না কি হয়! ঐ দেখো!

আসাদ: আরে! প্রধানমন্ত্রী তো চলে যাচ্ছেন! ওদের তো সুযোগই দেয়া হলো না!

কাকন: কি করে দেবেন? প্রধানমন্ত্রী তো অনেক ব্যস্ত! স্কুলের কিশোরদের কথা শোনার মত সময় কি তার আছে? ইশ্! দেখোই না! ওদের কী মন খারাপ!

কাকন: এই কারা যেন আসছে। চলো তো দেখি।

দৃশ্য:৯

স্থান: রাস্তা

সময়: সকাল

চরিত্র:    শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মুজিব, মুজিবের সঙ্গীরা, সাব ডিভিশনাল অফিসার [স্কুল পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী দলবলসহ কাঁচা রাস্তায় পায়ে হেঁটে কাছেই ডাক বাংলোর দিকে যাচ্ছেন]

নেপথ্যে: আমাদের দাবি, আমাদের দাবি, মানতে হবে, মানতে হবে!

শেরে বাংলা: কারা ওরা?

সাব ডিভিশনাল অফিসার: স্যার, গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলের ছাত্ররা। স্যার, আমি দেখছি।

সাব ডিভিশনাল অফিসার: এই!  তোমরা আবার এসেছ?

শেরে বাংলা: দাঁড়াও! আমি ওদের সাথে কথা বলতে চাই! ওদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধিকে ডাক!

সাব ডিভিশনাল অফিসার: এই! তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান প্রধানমন্ত্রী! সবার পক্ষ থেকে একজন এসো। কে কথা বলবে?

[কিশোরদের মধ্যে ভীতি, এবং গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে] [কেউ এগিয়ে আসার সাহস করে না]

সাব ডিভিশনাল অফিসার: কে কথা বলবে?? কে কথা বলবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে?

মুজিব: আমি কথা বলবো!  [সব গুঞ্জন বন্ধ হয়ে যায়।] [মুজিব শেরে বাংলার সামনে এসে দাঁড়ায়।]

প্রধানমন্ত্রী: তোমাদের সাহস তো কম নয়! আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছ! জানো আমি কে?

মুজিব: জানি! আপনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক।

শেরে বাংলা: তোমরা আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছ কেন?

মুজিব: আমাদের ছাত্রদের কিছু দাবি-দাওয়া আছে আপনার কাছে!

শেরে বাংলা: তোমাদের দাবি? আমার কাছে? বলো কী?

মুজিব: আমাদের স্কুল-হোস্টেলের ছাদ দিয়ে বর্ষাকালে অনবরত পানি পড়ে, এতে আমাদের বইখাতা, বালিশ, তোষক ও লেপ ভিজে যায়। তাই হোস্টেলের ছাদ মেরামত করার ব্যবস্থা না করলে পথ ছাড়বো না।

[চারিদিকে গুঞ্জন] [শেরে বাংলা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন]

শেরে বাংলা: কত টাকা লাগবে?

মুজিব:  ১২০০ টাকার মত! [সাব ডিভিশনাল অফিসার পাশে দাঁড়িয়ে]

শেরে বাংলা: বেশ! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুল হোস্টেলের ছাদ মেরামত করার ব্যবস্থা করুন।

শেরে বাংলা: তোমার সৎ সাহস ও নির্ভীক উত্তরে আমি খুব খুশি। কি নাম তোমার?

মুজিব:  আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

গান: শোন একটি মুজিবেরর কণ্ঠে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।

কাকন: এই হলো আমাদের কিশোর মুজিব। কি আসাদ? পেলে তো বঙ্গবন্ধুর দেখা?

আসাদ: হ্যাঁ! কিশোর বঙ্গবন্ধুর এই দায়িত্বশীলতা আর সাহসিকতা আমায় সত্যিই মুগ্ধ করেছে। বন্ধুরা তোমাদের কেমন লেগেছে আমাদের আজকের এই ভ্রমণ?

কাকন:  এবার তাহলে ফিরে যাওয়ার পালা। বন্ধুরা। আজ তাহলে বাড়ি ফিরে যাই? আবার দেখা হবে! ভালো থেকো সবাই।

[টাইম মেশিনে চড়ে প্রস্থান]

সমাপ্ত