সুপ্রভাত ডেস্ক »
একটি হলো তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘সাঁওতাল দম্পতি’ এবং অন্যটি এক বসে থাকা নারীর তেলচিত্র। দুই ছবির মধ্যে ‘সাঁওতাল দম্পতি’ চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। ১৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ছবি দুটির নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।
নিলামে ‘সাঁওতাল দম্পতি’ ছবির মূল্য ধরা হয়েছিল এক লাখ থেকে দেড় লাখ মার্কিন ডলার। কিন্তু চিত্রকর্মটি বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ডলারে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার ৫৩৩ টাকা।
বসে থাকা নারীর চিত্রকর্ম বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলারে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার ৬২৩ টাকার সমান।
নিলামে বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর শিল্পকর্মের জন্য এটিই সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হওয়ার রেকর্ড বলে বলছেন শিল্পবোদ্ধারা।
গত সপ্তাহে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সোদেবি’স নিউ ইয়র্কে ‘মডার্ন অ্যান্ড কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়ান আর্ট’ শীর্ষক এক নিলামের আয়োজন করে। মার্চের ১৮ তারিখ সেখানেই বিক্রি হয় জয়নুল আবেদিনের ওই দুইটি পেইন্টিং।
সোদেবি’সের ওয়েবইটে দেয়া তথ্য বলছে, নিলামে ‘সাঁওতাল দম্পতি’ চিত্রকর্মটি বিক্রি হয়েছে তিন লাখ ৮১ হাজার ডলারে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় যা চার কোটি ১৭ লাখ সাড়ে ছয় হাজার টাকা।
নিলামে এই ছবিটির মূল্য ধরা হয়েছিল এক লাখ থেকে দেড় লাখ মার্কিন ডলার।
পেইন্টিং দুইটি সম্বন্ধে যা জানা যায়
জয়নুল আবেদিনের আঁকা ‘সাঁওতাল দম্পতি’ পেইন্টিংয়ে দেখা যায়, মাথায় মাথাল অর্থাৎ বাঁশ বা বেতের তৈরি এক ধরণের গ্রামীণ টুপি পরে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক যুগল।
ছবিটি জয়নুল আবেদিন এঁকেছিলেন ১৯৬৩ সালে। পেইন্টিং-এর ওপরে তার নাম স্বাক্ষর করা আছে।
তেলরঙ দিয়ে ক্যানভাসে আঁকা এই পেইন্টিংটি প্রস্থে ১০২ এবং দৈর্ঘ্যে ১৩৫ দশমিক পাঁচ সেন্টিমিটার।
সোদেবি’সের ওয়েবইটে দেয়া তথ্য বলছে, পেইন্টিংটি জামশেদ কে. মার্কার এবং ডিয়ানা জে. মার্কারের পারিবারিক সংগ্রহশালায় ছিল।
পেইন্টিংটি প্রাপ্তির উৎস হিসেবে বলা আছে, ১৯৬৩ সালে সরাসরি শিল্পীর কাছ থেকে জামশেদ কে. মার্কার এবং ডিয়ানা জে. মার্কার এটি পেয়েছেন।
এই দুইজনই জয়নুল আবেদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
শিল্পী প্রায়ই মার্কার দম্পতির বাড়িতে যেতেন এবং সেসময় শিল্পী রশীদ চৌধুরীসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ ক’জন বিখ্যাত শিল্পীকে মার্কার দম্পতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
সোদেবি’স এই পেইন্টিংটির ভিত্তিমূল্য রেখেছিলো এক থেকে দেড় লাখ মার্কিন ডলার।
তবে এই পেইন্টিংটি কে কিনেছেন, সে বিষয়ে সোদেবি’স এর ওয়েবসাইটে কোনও তথ্য দেয়া হয়নি।
এর আগে ২০১৮ সালে নিউইয়র্কের নিলামকারী প্রতিষ্ঠান ক্রিসটিজে জয়নুল আবেদিনের সাঁওতাল সিরিজের আরেকটি চিত্রকর্ম নিলামে বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হয়।
দ্বিতীয় পেইন্টিংয়ে একজন নারীকে এঁকেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তাতে লাল চুড়ি হাতে এবং আকাশি নীল রঙা শাড়ি পরে একজন ক্লান্ত নারী বসে আছেন।
ছবিটি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সালের মাঝে তেলরঙ দিয়ে বোর্ডের ওপর আঁকা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৮০ দশমিক চার সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ৬০ দশমিক চার সেন্টিমিটারের একটু বেশি।
এটিও মার্কার দম্পতির পারিবারিক সংগ্রহে ছিল, যা গত ১৯শে মার্চ বিক্রি হয়ে যায়।
সোদেবি’স এর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এই পেইন্টিংটির দাম রাখা হয়েছিলো ৮০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৮৮ লাখ থেকে এক কোটি ৩২ লাখ টাকা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটিও তিনগুণেরও বেশি মূল্যে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ, এর দাম উঠেছে দুই লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার বা তিন কোটি ছয় লাখ টাকারও কিছু বেশি।
এই চিত্রকর্মটিরও ক্রেতা কে বা কারা, সে সম্পর্কেও সোদেবি’স কিছু জানায়নি।
এত দামে পেইন্টিং বিক্রি ‘এবারই প্রথম’
শিল্পবোদ্ধাদের মতে, যেকোনও ছবি আসল হলে এমন বেশি দামে বিক্রি হওয়ার ঘটনা ‘খুবই সাধারণ’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেছেন, তার জানামতে এর আগে বাংলাদেশি কোনও শিল্পীর আঁকা পেইন্টিং এত দামে বিক্রি হয়নি।
“আমার জানা মতে নেই…বাংলাদেশের আর্টিস্টের নেই। বিশেষ করে, তিন লক্ষ ৮১ হাজার ডলার হাইয়েস্ট এখন পর্যন্ত। তবে (আমার) অজানা আরও থাকতে পারে।”
সোদেবি’সের এই নিলাম বেশ সুপরিচিত জানিয়ে অধ্যাপক হোসেন বলেছেন, “উপমহাদেশের অনেক ছবিই (নিলামে) গেছে। আরও অনেকের ছবি বিক্রি হয়েছে। এটা খুব কমন। প্রতিমাসেই কিছু না কিছু বিক্রি হতে থাকে।”
চিত্রক গ্যালারির নির্বাহী পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, “জয়নুল আবেদিন স্যারের আঁকা পেইন্টিং…এগুলো অমূল্য। তাই, অরিজিনাল হলে এমন দাম হতেই পারে।”
“জয়নুল আবেদিন, শফিউদ্দিন, কামরুল কিংবা এস এম সুলতান -এ যারা আছেন, তাদের ছবির দাম ওই রকম হতে পারে।”
তবে “পেইন্টিং-এর দাম সাইজ ও সাবজেক্টের ওপর নির্ভর করে” বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এই শিল্পী বলেছেন, “দুই কোটি, আড়াই কোটি টাকায় পেইন্টিং বিক্রি হয়। যেমন, রফিকুন নবী (বাংলাদেশের চিত্রকর) বড় একটি ছবি সম্প্রতি ৬৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে।”
তবে তিনিও জানান যে,”তিন কোটি বা বিশেষ করে চার কোটি টাকার কাছাকাছি দামে এর আগে ‘সম্ভবত’ কারও চিত্রকর্ম বা পেইন্টিং বিক্রি হয়নি।”
‘বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলার পুরোধা’
জয়নুল আবেদিনকে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, কয়েক দশক আগেও চিত্রশিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাভিত্তিক কোনও ঐতিহ্য ছিল না।
কিন্তু তিনি তার নেতৃত্ব ও মেধা দিয়ে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, ১৯৪৮ সালে ঢাকায় তার প্রতিষ্ঠা করা ‘ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্টস’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে যেটিকে আমরা ‘চারুকলা ইনস্টিটিউট’ হিসেবে জানি।
শিল্পী এবং শিল্পবোদ্ধারা বলছেন, একদিকে শিল্পী হিসেবে নিজের সমস্ত চিত্রকর্মে বাংলার মাটি, জল, মানুষ, ইতিহাসকে তুলে ধরা ও অপরদিকে এদেশের চিত্রকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া – এসবের জন্যই তিনি শিল্পাচার্য, অর্থাৎ শিল্পের গুরু বা শিক্ষক হিসেবে ভূষিত হয়েছেন।
শিল্পীর জন্ম ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলায়। তিনি ১৯৩৩ সালে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং পাঁচ বছর সেখানে ইউরোপীয় স্টাইলের ওপর পড়াশুনা করেন।
এরপর ১৯৩৮ সালে তিনি আর্ট স্কুল অনুষদে যোগ দেন এবং ১৯৩৮ সালে সর্ব ভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে তার আঁকা জলরঙের ছবির জন্য তিনি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন।
তার ছবির মূল বিষয়বস্তু ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ, যা ছিল তার আশৈশব প্রেরণার বিষয়।
এ স্বীকৃতিই তাকে প্রথমবারের মতো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে এবং তিনি তার নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস লাভ করেন।
তিনি রং তুলির আঁচড়ে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ছবি ধারাবাহিকভাবে আঁকেন। সেই সময়ে তার আঁকা চিত্রকর্মগুলো তাকে ব্যাপক খ্যাতি এনে দেয়।
ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, যেমন ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, ১৯৭১ সালে সংঘটিত হওয়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার আঁকা ছবিগুলোও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।
তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘দ্য রেবেল ক্রো’ (জলরং, ১৯৫১), ‘দুই মহিলা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩), ‘পাইন্যার মা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩) এবং ‘মহিলা’ (জলরং, ১৯৫৩), ৬৫ ফুট দীর্ঘ স্ক্রল পেইন্টিং (চাইনিজ ইঙ্ক, জলরঙ ও মোম) ‘নবান্ন’, ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা’ ইত্যাদি।
যুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালে জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁও-এ একটি লোকশিল্প জাদুঘর এবং ময়মনসিংহে একটি গ্যালারি (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা) প্রতিষ্ঠা করেন।
ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের মধ্যবর্তী জায়গায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা